আর্টিকেল ৩৭০ (Article 370): আজ আর্টিকেল 370 নিয়ে এত আলোচনা এত তর্কাতর্কি চলছে । কিন্তু আমরা কজন ই বা এর ব্যাপারে জানি ? কেন এই ধারা রদ করা হল। এসব প্রথম থেকে দেখতে গেলে পিছিয়ে যেতে হবে অনেকটা সময়। স্বাধীনতারও আগের সময়। তাহলে চলুন আজ জেনে নিই আর্টিকেল 370 র ব্যাপারে।
এসব শুরু হয়েছিল ১৯৪৭ সালের ২৬শে অক্টোবর যখন ভারত সরকার ও মহারাজা হরি সিং এর মধ্যে এক বিশেষ চুক্তি র পর জন্মু ও কাশ্মির ভারতের অংশ হয় । এরপর ১৯৫০ এর ২৬শে জানুয়ারি যখন সংবিধান গৃহীত হলো তখন জন্মু ও কাশ্মির সংক্রান্ত দুটো আর্টিকেল এর কথা বলা হলো । একটা হলো আর্টিকেল 1 , যার ফলে জন্মু ও কাশ্মির ভারতের অংশ হয় আর দ্বিতীয় টা হলো আর্টিকেল ৩৭০, যার ফলে জম্মুকাশ্মীরকে ভারতীয় সংবিধানের আওতামুক্ত রাখা হয় এবং ওই রাজ্যকে নিজস্ব সংবিধানের খসড়া তৈরির অনুমতি দেওয়া হয়। এই আর্টিকেল বলে ওই রাজ্যে সংসদের ক্ষমতা সীমিত।
১৯৫০ সালে ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ৩৭০ ধারার অধীনে প্রথম সাংবিধানিক অর্ডার প্রয়োগ করেন- Constitution (Application to Jammu and Kashmir) Order. এতে আরও একাধিক বিষয় অন্তভুর্ক্ত ছিল। তার সঙ্গেই এখানে যুক্ত হয়েছিল Schedule II- এখানে সংবিধানের সেই মডিফিকেশন অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল যেগুলি এই রাজ্যে প্রয়োগ করা যাবে।
আপনি যদি ভারতের সংবিধান পড়েন তাহলে সেখানে আর্টিকেল ৩৭০ এর ৩৫ A দেখতে পাবেন না। এটা শুধু আছে জন্মু ও কাশ্মিরের সংবিধানে।
১৯৫৬ সালে জম্মু কাশ্মীরের সংবিধান কাজ শুরু করে। এর সঙ্গে একটি Declaration ছিল- যেখানে বলা হয় জম্মু-কাশ্মীর সর্বদা Union of India-এর অবিচ্ছেদ্য অংশ থাকবে।
১৯৫৬ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত জন্মু ও কাশ্মিরের রাজনীতি ও অর্থনীতির অনেক পরিবর্তন হয়েছে । ২০১৬ সালে হয় State Bank of India vs Santosh Gupta মামলা। এখানে ভারত সরকারের একটি আইন Securitisation and Reconstruction of Financial Assets and Enforcement of Security Interest Act, ২০০২ -কে চ্যালেঞ্জ করে মামলা করা হয়। বলা হয়েছিল এই আইন ১৯২০ সালের Jammu and Kashmir Transfer of Property Act-এর সঙ্গে বিরোধিতা তৈরি করেছে। সরকারের আইনকেই স্বীকৃতি দিয়ে রায় দিয়েছিল সুপ্রিম কোর্ট। সেই সঙ্গে পর্যবেক্ষণ রেখেছিল যে ৩৭০ ধারার অপারেশনের কোনও নির্দিষ্ট সময়সীমা নেই। এটি রদ করার জন্য Constituent Assemebly থেকে কোনওরকম সুপারিশ না আসা পর্যন্ত এই ধারা বলবৎ থাকবে।
ভারতীয় জনতা পার্টি (BJP) , পিডিপি -এর সঙ্গে জোট বেঁধে সরকার তৈরি করেছিল । এই জোটের তরফে জন্মু ও কাশ্মিরের মুখ্যমন্ত্রী হন মেহবুবা মুফতী। ২০১৮ সালে বিজেপি সরকারের উপর থেকে পিডিপি সমর্থন তুলে নেয়। তারপরেই রাজ্যপালের শাসন জারি হয় জম্মু ও কাশ্মীরে। ৬ মাস মেয়াদ শেষে ওই বছরেই ডিসেম্বরে জম্মু কাশ্মীরে ৩৫৬ ধারা প্রয়োগ করে রাষ্ট্রপতির শাসন জারি হয়। সংসদের দুই কক্ষেই পাস হয় proclamation.
২০১৯ সালে রাষ্ট্রপতি একটি অর্ডার জারি করেন, সেখানে Constituent Assembly-এর ইন্টারপ্রিটেশন অন্তর্ভুক্ত (Amend) করার জন্য বলা হয়। অর্থাৎ এর অর্থ সংশোধনের জন্য বলা হয়। গণ পরিষদের সংজ্ঞা পাল্টে বিধানসভা করা হয়। এর অর্থ হল রাষ্ট্রপতির কোনও আদেশ বিধানসভার অনুমোদন সাপেক্ষে করা হবে। যেহেতু জম্মু ও কাশ্মীর রাষ্ট্রপতি শাসনের অধীনে ছিল, তাই বিধানসভার ওই কাজ সংসদের মাধ্যমেই পূর্ণ হয়েছিল।
দেখুন আর্টিকেল ৩৭০ নেওয়া হয়েছিল কারণ ১৯৪৭ সালের চুক্তিতে জন্মু ও কাশ্মিরকে ভারতের অংশ করার পরিবর্তে বিশেষ মর্যাদা দেওয়ার কথা হয়েছিল। আর্টিকেল ৩৭০ র কাজ কী?
এটা জন্মু ও কাশ্মিরকে এক বিশেষ মর্যাদা দেয় । যার ফলে এখানকার সংবিধান ভারতের অন্যান্য রাজ্যের থেকে আলাদা।
কিন্তু এখানে এটাও বলা হয়েছিল যে ভারতের রাষ্ট্রপতি নিজের ইচ্ছায় এটাকে বাতিল ও করতে পারেন। কিন্তু তার আগে জন্মু ও কাশ্মিরের Constituent Assembly র অনুমতি দরকার । তাহলে আর্টিকেল ৩৭০ বাতিল করতে এত সময় লাগলো কেন ? এর কারণ এখানে যে Constituent Assembly র কথা বলা হয়েছে সেটা ১৯৫৭ সালেই বন্ধ হয়ে গেছে । যে কারণে এই আর্টিকেল বাতিল করতে সমস্যা হচ্ছিল। এর ই একটা সহজ সমাধান বের করা হয় ২০১৯ এ।
২০১৯ সালের আগস্টে সংসদে পেশ করা হয় জম্মু ও কাশ্মীর পুনর্গঠন বিল। সেদিনই পাস হয়ে যায় সেটি। ওই বছরেই 9 আগস্ট রাষ্ট্রপতি সম্মতি দেওয়ার পরে সেটি আইনে পরিণত হয়। তার মাধ্যমে জম্মু কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা সরিয়ে দেওয়া হয়। ৩৭০ অনুচ্ছেদের ১ ধারা ব্যতীত সব বিধান বিলোপ করা হয়। ১ ধারা অনুযায়ী, ভারতের সংবিধান জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের উপর বলবৎ হবে বলা ছিল। জম্মু ও কাশ্মীয় এবং লাদাখ – এই দুটি আলাদা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল করা হয়। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল যে জম্মু ও কাশ্মীরের কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে একটি বিধানসভা থাকবে, লাদাখে বিধানসভা থাকবে না।
তৎকালীন প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈ, বিচারপতি এস এ বোবদে এবং বিচারপতি আবদুল নাজিরের তৈরি ৩ সদস্যের বেঞ্চ এই ৩৭০ ধারা রদের বিষয়টির সাংবিধানিক বৈধতা সংক্রান্ত শুনানি শুরু করে। পরে সেই বেঞ্চ এই বিষয়টিকে পাঁচ সদস্যের সাংবিধানিক বেঞ্চে পাঠায়।
২০২০ সালে একটি মামলা হয় সেখানে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এনভি রামানার নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের বেঞ্চ এই মামলাটি আরও বড় বেঞ্চে পাঠানোর দাবি খারিজ করে দেয়।
৩৭০ ধারার সাংবিধানিক ভিত্তি চ্যালেঞ্জ করে যে মামলা চলছিল, ২০২৩ সালে সেটি নতুন একটি সাংবিধানিক বেঞ্চের কাছে আসে। ওই বেঞ্চের নেতৃত্বে ছিলেন প্রধান বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড়, ছিলেন বিচারপতি সঞ্জয় কিষাণ কৌল, বিচারপতি সঞ্জীব খান্না,বিচারপতি বি আর গাভাই এবং বিচারপতি সূর্য কান্ত। বাদী-বিবাদী পক্ষের দীর্ঘ সওয়াল-জবাব, শুনানির পরে ২০২৩ সালের ১১ই ডিসেম্বর ওই বেঞ্চ রায় দেয় যে জম্মু-কাশ্মীর থেকে ৩৭০ ধারা বিলোপের সিদ্ধান্ত ঠিক।
এবার দেখা যাক এর ফলে জন্মু ও কাশ্মীরের কী কী পরিবর্তন হবে?
প্রথমত ওখানকার মানুষদের দুটো নাগরিকত্বের বদলে একটা নাগরিকত্ব থাকবে।
দ্বিতীয়ত , পুরো ভারতে একটা ই সংবিধান থাকবে।
তৃতীয়ত , জন্মু ও কাশ্মিরের জাতিভেদ ও পুরুষ তান্ত্রিক সমাজের অবসান ঘটবে।
মনে রাখতে হবে, ভারতের গণতন্ত্র ও একতার মধ্যে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল আর্টিকেল ৩৭০। তাই এটা বাতিল হওয়ার সিদ্ধান্ত আগামী দিনে জন্মু কাশ্মীরের সাথে সাথেই পুরো ভারতের জন্য ই লাভজনক হবে বলে আশা রাখা যায়