Mawlynnong_Cleanest_village_of_AsiaMawlynnong_Cleanest_village_of_Asia_in_Meghalaya

মাওলিননং (Mawlynnong) : বর্তমান দিনে প্রতিটি মানুষেরই ইউরোপ-আমেরিকার প্রতি রয়েছে প্রবল আকর্ষণ। কারণ উন্নত দেশগুলোতে তাদের ঘুরতে যাওয়া বা স্থায়ীভাবে আবাসন গড়ার একটা আগ্রহ থেকেই থাকে । কারণ ওখানে পাওয়া যায় নাগরিক সুবিধা , অত্যাধুনিক জীবনযাপন , সুন্দর পরিবেশ , দূষণমুক্ত প্রকৃতি ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা যা আমাদের এখানে সহজেই দেখা যায় না ।

তাই কখনো যদি এশিয়ার সবচাইতে পরিষ্কার গ্রামের নাম প্রকাশ করা হয়, তবে নিশ্চয়ই সেটা ভারতীয় উপমহাদেশের কোথাও হবে না, এমনটা ভাবা স্বাভাবিক। কিন্তু জেনে অবাক হবেন, এশিয়া মহাদেশের সবচেয়ে পরিষ্কার গ্রাম  মাওলিননং -এর অবস্থান ভারতেই।

ঘন নীল আকাশ, সবুজে ভরা গাছগাছালি, রকমারি ফুলবাহারি, কত প্রজাপতির দল চারিদিকে উড়ে বেড়ায় এখানে । তাছাড়া এখানে আছে সুন্দর করে বাড়িগুলো সাজানো। এ গ্রামের সবাই শিক্ষিত। সুন্দর রুচির ছাপ সর্বত্র। ডাস্টবিনগুলোও সুন্দর, অদ্ভুত। না শুধু গ্রামকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রেখেই যে এই গ্রামটি পৃথিবীর সেরা গ্রাম, তা নয়। গ্রামের কোনও বাসিন্দাই যত্রতত্র আবর্জনা ফেলেন না বরং এখন তারা ও পরিবেশের সুরক্ষার কথা ভেবে প্লাস্টিকের ব্যবহার পুরোপুরি বন্ধ করার ওপরেও জোর দিয়েছেন ।

এই মাওলিননং গ্রামটি মেঘালয়ের রাজধানী থেকে প্রায় ৭৮ কিলোমিটার দূরে খাসিয়া পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত একটি ছোট্ট পরিষ্কার গ্রাম । ছোট্ট এই গ্রামটি ভারতের আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্রগুলোর মাঝে অন্যতম। প্রতিদিন এখানে দেশি-বিদেশী বহু দর্শনার্থী আসেন, বিশেষ করে বর্ষার মৌসুমে মাওলিননং হয়ে ওঠে প্রকৃতিপ্রেমীদের কাছে আকর্ষণীয় স্থান ।

ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী এই গ্রামটি কয়েক বছর আগেও ছিল অজানা । মূলত আলোচনায় আসে ২০০৩ সালের পর, ভ্রমণ ম্যাগাজিন ‘ডিসকভারি ইন্ডিয়া’র এক প্রতিবেদনের মাধ্যমে। যেখানে মাওলিননংকে এশিয়ার সবচেয়ে পরিষ্কার গ্রাম হিসেবে উল্লেখ করা হয়। এরপর ২০০৫ সালে, ভারতের সর্বাধিক পরিচ্ছন্ন গ্রামের স্বীকৃতি পায় এই গ্রাম। সচেতনতা, শিক্ষা আর দীর্ঘদিনের অভ্যাসের ফলেই গ্রামটি আজ ভারতবর্ষের রোল মডেলে পরিণত হয়েছে।

 

এই গ্রামের বাচ্চাদের ছোট থেকেই এমন শিক্ষা দেয়া হয় যে তারা প্রতিদিন সকালের ঘুম থেকে উঠে প্রথমে নিজের ঘর ও বাড়ির আঙিনা পরিষ্কার করে, তারপর স্কুলে যায়। নিজ নিজ দায়িত্বে রাস্তাঘাটের ময়লা সাফাই করার কাজে অংশ নেয় স্থানীয় মানুষেরাই । কোথাও কোনো আবর্জনা পড়ে থাকলে সেটা কারোও চোখে পড়া মাত্রই তা তুলে নিয়ে যথাস্থানে ফেলে আসে।

রাস্তার মোড়ে মোড়ে আছে বাঁশের তৈরি ডাস্টবিন যাতে পথচারীরা হেঁটে যাওয়ার সময় যেখানে সেখানে ময়লা না ফেলেন। এরপরেও কেউ ইচ্ছে করে কিছু নোংরা করলে তাকে পেতে হয় কঠিন শাস্তি। আর পর্যটকরা আইনভঙ্গ করলে জরিমানা করা হয় তাদেরও, সেই অর্থ আবার ব্যয় হয় পরিচ্ছন্নতার কাজেই। ডাস্টবিনের ময়লা ও প্রতিদিনের জমানো আবর্জনা দিয়ে তৈরি করা হয় জৈব সার। সেখানকার গ্রামবাসীরা গাছ লাগাতে ভালোবাসে বলে নিজেদের তৈরি সার কাজে লাগায় শখের বৃক্ষরোপণে।

মাওলিননং গ্রামে ধূমপান একেবারে নিষিদ্ধ।এমনকি মদ ও এখানে রাস্তাঘাটে খাবার কোন অনুমতি দেওয়া হয় না । সেই সাথে নেই কোনো প্লাস্টিকের ব্যাবহার। গ্রামবাসীরা যেমন পরিচ্ছন্নতার ব্যপারে গুরুত্ব দেয়, তেমনি পরিবেশ রক্ষার দিকেও সচেতনত । এখানেই শেষ নয় শিক্ষাদীক্ষাতেও এই গ্রামের বাসিন্দারা গোটা ভারতে অনন্য দৃষ্টান্ত রেখে চলেছে। ২০১৫ সালে বিজনেস ইনসাইডার কর্তৃক প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, মাওলিননং স্বাক্ষরতার হার শতভাগ।

আরো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো নিজেদের দেশকে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে আজও ‘স্বচ্ছ ভারত’ প্রকল্পের কথা ঘোষণা করতে হয় সরকারকে। আজও দেশের গ্রামাঞ্চলের প্রায় কুড়ি শতাংশ মানুষ মাঠে-ঘাটে শৌচকর্ম সারেন। কারণ তাদের বাড়িতে শৌচালয় নেই। আজও গ্রামাঞ্চলে মেয়ের বিয়ে দেওয়ার সময় খোঁজ নেওয়া হয় ছেলের বাড়িতে শৌচালয় আছে কিনা। কারন শৌচালয় না থাকার ঘটনা দেশের বিভিন্ন অংশে অত্যন্ত স্বাভাবিক। আজও রাস্তাঘাটে যেখানে সেখানে দাঁড়িয়ে মানুষকে মূত্র ত্যাগ করতে দেখা যায়। অথচ এই ভারতেই অবস্থিত এশিয়ার সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন গ্রাম মাওলিননং এ প্রকৃতিকে দূষণমুক্ত ও পরিষ্কার রাখার জন্য মাওলিননং এর মানুষজন বাড়ি বানানোর আগে তৈরি করে শৌচাগার।

যদিও এ গ্রাম মেঘালয়ের পাহাড়ঘেরা এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে অবস্থিত, তবুও সুশৃঙ্খল নিয়ম আর সদিচ্ছার কারণেই তারা হতে পেরেছে গোটা ভারতবর্ষের কাছে অনুকরণীয়। খোদ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও এই গ্রামের সম্পর্কে প্রশংসা করেছেন । এমনকি ২০১৬ সালে মাওলিননংকে আদর্শ হিসেবে সামনে রেখে ‘ক্লিন ইন্ডিয়া প্রোগ্রাম’ ক্যাম্পেইনের কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে পুরো ভারত জুড়ে।

২০১৯ সালের এক সমীক্ষা অনুযায়ী, মাওলিননং গ্রামের মোট অধিবাসী ৬০০ জন অর্থাৎ রয়েছে ৯৫টির মতো পরিবার। তাদের সকলেই জাতিগতভাবে খাসিয়া, তবে ধর্মীয়ভাবে খ্রিষ্টান।

এখানকার খাসিয়া সমাজে মাতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রচলিত রয়েছে। তাদের পরিবারপ্রধান হন একজন নারী। সন্তানদের নামের শেষে যুক্ত থাকে মায়ের উপাধি, মায়ের পরিচয়েই বড় হয় তারা। সম্পত্তির উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রেও মেয়েদের অগ্রাধিকার দেয়া হয়। মাওলিননং গ্রামে এর ব্যতিক্রম দেখা যায় না। বিয়ের পর বর চলে আসে কনের বাড়িতে। অবশ্য এ প্রথায় স্বামীকে কটাক্ষ করে ‘ঘরজামাই’ বলা হয় না, তাদের সমাজে এটিই স্বাভাবিক নিয়ম।বিয়ের পর নারীর বাড়িতে স্থায়ীভাবে বসবাস করার এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় মাতৃবাস।

জীবিকা

মাওলিননং এর অধিকাংশ মানুষই কৃষিজীবী। সুপারি এদের প্রধান ফসল । কেউ কেউ অবশ্য বর্ষার মৌসুমে পুরোদস্তুর ব্যবসায়ী হয়ে যায় । কারণ সেই সময় পর্যটকদের উপচে পড়া ভিড় থাকে এখানে । তাই বছরের এই সময়ে বেচাকেনাটাও হয় বেশ ভালোই। বর্ষা ছাড়াও মেঘালয় রাজ্যের বিভিন্ন আঞ্চলিক উৎসব উপলক্ষে দর্শনার্থীদের কম-বেশি আনাগোনা লেগে থাকে। আর মেঘালয় ঘুরতে গেলে অধিকাংশ পর্যটকই মাওলিননং গ্রামে ঘুরে আসে । কারণ এটি এশিয়া মহাদেশের সবচেয়ে পরিষ্কার গ্রাম বলে কথা ।

মাওলিননং এর দর্শনীয় স্থান

বেশিরভাগ পর্যটকই আসেন ছোট্ট এই গ্রামের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা একবার স্বচক্ষে দেখার জন্য । পুরো ভারতবর্ষ কিংবা মেঘালয় রাজ্যের তুলনায় মাওলিননং এ অনেক বেশি দর্শনীয় স্থান নেই ঠিক, তবে পাহাড়ের গা ঘেঁষা এই জায়গাটি প্রকৃতিপ্রেমীদের জন্য এক দুর্দান্ত জায়গা । স্থানীয়রা এ গ্রাম সম্পর্কে বলেন, ‘ঈশ্বরের বাগান’। তাই মাওলিননং এ ঘুরতে গেলে হতাশ হওয়ার সম্ভাবনা একেবারেই নেই। মনোমুগ্ধকর মাওলিননং এ কিছু দেখার মতো জায়গা আছে।

যেমন , জীবন্ত গাছের শেকড় দিয়ে তৈরি সেতু। নদীর দু’পাশে ছড়িয়ে থাকা রাবার গাছের শেকড়গুলো একসাথে জুড়ে দিয়ে তারপর লম্বা সময় ধরে পরিচর্যা করে বানানো এক একটি সেতু, যেগুলো আজও টিকে আছে অবাক করা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য হিসেবে । বর্তমানেও পুরনো পদ্ধতি অনুসারে জীবন্ত শেকড় দিয়ে সেতু গড়ছে মেঘালয়ের খাসিয়ারা।তবে এ কাজ যথেষ্ট সময়সাপেক্ষ। একটি সেতু সম্পূর্ণ চলাচলের উপযোগী হতে ১৫ বছরেরও বেশি সময় লাগে। মেঘালয় রাজ্যে বর্তমানে এরকম ১১টি সেতু রয়েছে, যার মধ্যে মাওলিননং এর পাশেও রয়েছে বেশ কয়েকটি । ইতোমধ্যেই এই সেতুগুলোকে বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে ইউনেস্কো। তাই এ গ্রামে ঘুরতে গেলে প্রকৃতির উপাদান কাজে লাগিয়ে মানুষের তৈরি এমন শিল্পকর্ম দেখতে ভোলে না কেউই।

বলাই যায় প্রতিবছর পৃথিবীর নানা প্রান্তে অস্বাভাবিক ভাবে আবহাওয়ার পরিবর্তন হচ্ছে। কোথাও প্রচন্ড গরমে পুড়ছে মানুষজন আবার কোথাও প্রবল বৃষ্টিতে ভেসে যাচ্ছে চারিদিক। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও গাছের অভাবে পৃথিবীতে দূষণের মাত্রা বেড়ে চলেছে প্রতিনিয়ত। ভারতেই যেমন এ বছর প্রচন্ড গরমে নাজেহাল হতে হয় সকলকে । একটু বৃষ্টির জন্য চাতক পাখির মতো আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল মানুষ। আর সেখানেই ভারতের আরেক প্রান্তের মনোরম প্রকৃতি ও এখানকার সংস্কৃতি দেখলে আপনি অবাক হয়ে উঠবেন  ।

By Amit Kumar Basak

উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনী অমিত এখন বেসরকারী চাকুরীরত । পড়াশোনার পাশাপাশি লেখাটাও তার একটা নেশার মধ্যে পরে ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *