Mahendra Sing Dhoni

মহেন্দ্র সিং ধোনি (Mahendra Singh Dhoni) : ভারতীয় ক্রীড়া জগতের ইতিহাসে কিংবদন্তী খেলোয়াড় মহেন্দ্র সিং ধোনি শুধু ভারতবাসীর কাছে নয়, সমগ্র বিশ্ববাসীর কাছে অবিস্মরণীয় নাম। ক্রীড়া ঐতিহ্যে ভারতীয় ক্রিকেটে অসাধারণ অধিনায়কত্বের জন্য তাকে ‘ক্যাপ্টেন কুল’ নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে। ক্যাপ্টেনিং, কিপিং, ব্যাটিং, ফিল্ডিং – সর্বত্রই তিনি তাঁর কৃতিত্বের পরিচয় রেখে দীর্ঘদিন ধরে ক্রিকেটপ্রেমী বিশ্ববাসীর মনের মধ্যে থেকে গেছেন । ক্রিকেট থেকে তাঁর অবসর ক্রীড়া প্রেমীদের কাছে সত্যই হতাশার।

ক্রীড়া জগতের অসাধারণ কৃতিত্বের অধিকারী মহেন্দ্র সিং ধোনি ৭ই জুলাই ১৯৮১ সালে বিহারের রাঁচিতে (অধুনা ঝাড়খণ্ডে) এক অতি সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা পান সিং ও মাতা দেবকী দেবী -র সবচেয়ে ছোট ও আদরের সন্তান ছিলেন ধোনি। বড় দাদা নরেন্দ্র সিং ও দিদি জয়ন্তী দেবীই ছিলেন তার প্রথম ক্রীড়া জীবনের সঙ্গী। শৈশব থেকেই মাহি নামেই বেশি পরিচিত ছিলেন। ধোনি তার সহধর্মিণী রূপে সাক্ষী রাওয়াতের সঙ্গে ২০১০ সালে বিয়ে করেন । মহেন্দ্র সিং ধোনি ও সাক্ষী ধোনির একমাত্র কন্যা জিভা সিং।

শিক্ষা জীবন

মহেন্দ্র সিং ধোনির প্রাথমিক শিক্ষা চালু হয় রাঁচির কাছে শ্যামলীতে ডিএভি জহর বিদ্যা মন্দিরে। এখান থেকেই লেখাপড়ার পাশাপাশি খেলাধুলাতেও হাতে খড়ি হয়। এখানে তিনি ব্যাডমিন্টন ও ফুটবল খেলার প্রশিক্ষণ নিতে থাকেন।

খেলার ধরণ

মহেন্দ্র সিং ধোনি শৈশবে গোলকিপার হিসাবে নিজের প্রশিক্ষণ শুরু করলেও পরবর্তীতে হয়ে উঠেছেন এক সফল ডানহাতি ব্যাটসম্যান ও উইকেটরক্ষক। তবে তিনি এযাবৎ জুনিয়র উইকেটরক্ষক হিসেবে সর্বকালের সেরা হয়ে উঠেছেন। মাহির বিহার ক্রিকেট দলে অভিষেক ঘটে ১৯৯৮-১৯৯৯ মরশুমে। এরপর ২০০৪ সালে ভারতীয় দলের হয়ে কেনিয়া সফরে যান। 

অসাধারণ পারফরম্যান্সের জন্য ঐ বৎসরই ভারতীয় জাতীয় ক্রিকেট দলের সদস্য হিসেবে মনোনীত হন।২০০৫ সালে ধোনি তার ব্যক্তিগত পঞ্চম একদিবসীয় ক্রিকেটে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ ১৪৮ রান করেন। এ বছরই তিনি নিজের রেকর্ড ভেঙে তৎকালীন বিশ্বরেকর্ড হিসেবে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ১৮৩ রান করেন। এভাবে ক্রিকেটে ধারাবাহিক সাফল্যের পরই টেস্ট টিমে যেমন তার অভিষেক ঘটে। এসময় তেমনি আইসিসি ওডিআই রেটিংয়ে ১নং ব্যাটসম্যান হিসেবে মর্যাদা পান ধোনি। ২০০৭ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সহ অধিনায়ক হিসেবে পথ চলা শুরু হয় তার।

অধিনায়ক হিসেবে

২০০৭ সালে ইংল্যান্ড সফরে একদিবসীয় ক্রিকেটে সহ অধিনাকত্বের দায়িত্ব পালন করার পরই সেপ্টেম্বর ২০০৭ সালে আইসিসি বিশ্বকাপ টি20 ক্রিকেটে ভারতীয় ক্রিকেট দলের অধিনায়ক হিসেবে নেতৃত্ব দেন। এখানে যথাযোগ্য নেতৃত্ব দানের মাধ্যমে ফাইনালে চির প্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তান দলকে কার্যত পরাজিত করে প্রথম টি20 বিশ্বকাপ জয়ী দলের মর্যাদা লাভ করেন। তারপর ঐ বৎসরের সেপ্টেম্বর মাসে অস্ট্রেলিয়া সফরে একদিবসীয় ক্রিকেটের অধিনায়ক হিসেবে ডাক পান। 

নভেম্বর ২০০৮ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে নাগপুরে চতুর্থ ও চূড়ান্ত ম্যাচে অনিল কুম্বলের অবসরকালে ধোনি অধিনায়ক হিসেবে ভারতীয় টেস্ট দলের নেতৃত্ব দিয়েছেন। তার নেতৃত্বেই দীর্ঘ ২০ বছর পর টেস্ট ক্রিকেটে অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে অস্ট্রেলিয়াকে হারাতে সক্ষম হয়েছে ভারত ।এরপর একে একে আইসিসির সমস্ত ফরম্যাটে যথা টি20 বিশ্বকাপ (২০০৭) ও ওয়ানডে বিশ্বকাপ জয় (২০১১), টেস্টে র‍্যার্ঙ্কিংয়ে শীর্ষস্থান দখল (২০০৯) ও চ্যাম্পিয়ান্স ট্রফির (২০১৩) জয়লাভ করেন তিনি । তিনিই বিশ্বের প্রথম অধিনায়ক হিসেবে আইসিসির সব টুর্নামেন্ট জয় করার কৃতিত্ব রেখেছেন । এছাড়া দেশে-বিদেশে সাফল্যের নিরিখে ভারতীয় ক্রিকেটে দলে তিনি হয়ে উঠেছেন সর্বকালের শ্রেষ্ঠ অধিনায়ক।

ঘরোয়া ক্রিকেট

ধোনি ১৯৯৮-৯৯ সালে বিহার ক্রিকেট এসোসিয়েশনের অনুর্ধ্ব ১৯ দলে যুক্ত হন। ৫টি খেলায় ৭টি ইনিংসে ১৭৬ রান করেন। মাত্র ১৮ বছর বয়সে ১৯৯৯-২০০০ মৌশুমে বিহার ক্রিকেটের হয়ে রঞ্জি খেলায় অংশ গ্রহণ করেন। ২০০০-০১ মৌসুমে বেঙ্গল ক্রিকেটের বিরুদ্ধে প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে ১ম সেঞ্চুরী করেন। এছাড়াও ইস্ট জোন ক্রিকেটের পক্ষে দেওধর ট্রফি জয়ের ব্যাপক ভূমিকা রাখেন।

ধোনি এই সাফল্যের জন্য ২০০৩-০৪ মৌসুমে ভারতীয় দলের হয়ে জিম্বাবুয়ে ও কেনিয়া সফরে যান। পরে পাকিস্তান দলের বিরুদ্ধে দুটি সেঞ্চুরি করার পাশাপাশি ৭টি খেলায় ৬টি ইনিংসে ৭২.৪০ গড়ে ৩৬২ রান করে জাতীয় দলের তৎকালীন অধিনায়ক সৌরভ গাঙ্গুলী, রবি শাস্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।ভারতের খুবই জনপ্ৰিয় আইপিএল বা ইন্ডিয়ান প্রিমিয়াম লিগে ২০০৮ সালে ১.৫ মিলিয়ন ডলারের চুক্তিতে চেন্নাই সুপার কিংস দলের হয়ে খেলেছেন।

Mahendra Sing Dhoni

ক্রিকেট কেরিয়ার

মহেন্দ্র সিং ধোনির জীবনের চাকা ঘুরে যায় ২৩শে ডিসেম্বর ২০০৪ সালে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ভারতীয় জাতীয় দলের হয়ে একদিনের প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচে। যদিও অভিষেক ম্যাচে ধোনিকে শূন্য রানে রান আউট হয়ে ফিরতে হয়। ঠিক তার পরের বছরই ২০০৫ সালের ২রা ডিসেম্বর শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে তার কেরিয়ারের প্রথম টেস্ট ম্যাচ খেলেন। ২০০৬ সালের ১লা ডিসেম্বর দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে তার প্রথম আন্তর্জাতিক টি20 ম্যাচ খেলেন।
পরিসংখ্যান অনুপাতে ধোনি তার কেরিয়ারে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ৯০টি টেস্ট ম্যাচ খেলে ৬টি শতরান , ৩৩টি অর্ধশতরান, ২৫৬টি ক্যাচ, ৩৮টি স্ট্যাম্পিং ও সর্বাধিক ২২৪ রান সহ ৪৮৭৬ রান করেন। একদিনের ক্রিকেটে ৩৫০ ম্যাচে ১০টি শতরান, ৭৩টি অর্ধশতরান, ৩২১টি ক্যাচ ও ১২৩টি স্ট্যাম্পিং, ১টি উইকেট ও সর্বোচ্চ ১৮৩ রান সহ মোট ১০৭৭৩ রান করেন। এছাড়া আন্তর্জাতিক টি20 ক্রিকেটে ৯৮ ম্যাচে ২টি অর্ধশতরান, ৫৭টি ক্যাচ, ৩৪টি ক্যাচ ও সর্বোচ্চ ৫৬ রান সহ মোট ১৬১৭ রান করেন।

অবসর

২০১৪-১৫ মৌসুমে অস্ট্রেলিয়া সফরে তার শেষ টেস্ট সিরিজে অংশ নেওয়ার পর ডিসেম্বর ২০১৪ সালে টেস্ট ক্রিকেট থেকে অবসর নেন। শেষ টেস্টে ৮টি ক্যাচ ও ১টি স্টাম্পিং সহ ৯টি আউটে সহায়তা করেন যা এক রেকর্ডও বটে।
পরবর্তীতে সমস্ত জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে ১৫ই আগষ্ট ২০২০তে ৭৪তম স্বাধীনতা দিবসের দিন আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে বিদায় নেন। ইন্সট্রাগ্রামে ধোনি এক ভিডিও বার্তায় আন্তর্জাতিক টি20 ও একদিবসীয় ক্রিকেট থেকে অবসরের কথা ঘোষণা করেন। ২৭শে ফেব্রুয়ারি ২০১৯ অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে তার কেরিয়ারের শেষ আন্তর্জাতিক টি20 ম্যাচ খেলেন। ৯ই জুলাই ২০১৯ সালে বিশ্বকাপ ক্রিকেটের নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সেমিফাইনাল ম্যাচই তার কেরিয়ারের একদিবসীয় ক্রিকেটের শেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচ।

পুরস্কার ও সম্মান

ভারতীয় ক্রিকেট দলের উইকেট রক্ষক-ব্যাটসম্যান তথা এদেশের সবচেয়ে সফল অধিনায়ক মহেন্দ্র সিং ধোনি এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তার খেলোয়াড় জীবনে পেয়েছেন অনেক পরিমাণে ভারতবাসীর ভালোবাসা। ধোনিই প্রথম ভারতীয় হিসেবে ২০০৮ ও ২০০৯ সালে আইসিসির একদিনের ক্রিকেটে বর্ষসেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার পান। এছাড়াও ভারতের সর্বোচ্চ ক্রীড়া সম্মান ‘রাজীব গান্ধী খেলরত্ন পুরস্কার’ ও দেশের চতুর্থ বেসামরিক সম্মান ‘পদ্মশ্রী’ পুরস্কার পেয়েছেন।

বিজ্ঞাপন জগতে অংশগ্রহণ

এপ্রিল, ২০০৫ থেকে কলকাতাভিত্তিক তারকা ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠান গেমপ্লান স্পোর্টস্‌ কোম্পানীর সাথে চুক্তিতে আবদ্ধ রয়েছেন ধোনি। .বর্তমানে ধোনি ২০টি প্রতিষ্ঠানের সাথে বিজ্ঞাপনচিত্রে অংশগ্রহণ করছেন। একমাত্র হিন্দী চলচ্চিত্রাভিনেতা শাহরুখ খান তার চেয়ে ১টি বেশি বিজ্ঞাপন করছেন। ২০০৭ সালে তিনি ১৭টি কোম্পানীর সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিলেন। তিনি যেসব বিজ্ঞাপন গুলো করেছিলেন তা হলো , পেপসিকো,রিবক, এক্সাইড,টিভিএস মোটর্স, মহিশুর স্যাণ্ডেল সোপ,ভিডিওকোন, রিলায়েন্স কমিউনিকেশন্স, রিলায়েন্স এনার্জি, অরিয়েন্ট পিএসপিও ফ্যান, ভারত পেট্রোলিয়াম,টাইটান সোনাটা,ব্রাইলক্রিম,এনডিটিভি, জিই মানি, সিয়ারাম,ফ্যাশন এট বিগ বাজার, মহা চকো, বুষ্ট (হেলথ্‌ ফুড), ডাবুর হানি, কলকাতা ফ্যাশন উইক,এয়ারসেল কমিউনিকেশনস্‌, নোভা স্কোটিয়া প্রিমিয়াম শার্টস্‌ ইত্যাদি।

মোট সম্পত্তি

মহেন্দ্র সিং ধোনি কোটি টাকার সম্পত্তি, বিলাসবহুল প্রাসাদ, গাড়ি এবং মহামূল্যবান মোটরবাইকের মালিক। বিশ্বের সবথেকে ধনী খেলোয়াড়দের তালিকায় তাঁর নাম রয়েছে। হোটেল থেকে এয়ারস্পেস, সব জায়গাতেই ধোনির মালিকানা রয়েছে। মহেন্দ্র সিং ধোনি রাঁচিতে বসবাস করেন। তাঁর বাড়িটা রাজপ্রাসাদের থেকে কোনও অংশে কম নয়। ২০১৭ সালে ধোনি এই বাড়িতে শিফট করেছিলেন। তাঁর বাড়ির নাম ‘কৈলাশপতি’। ইতিপূর্বে রাঁচির একটা হাউসিংয়ে তিন তলা বাড়িতে থাকতেন ধোনি। পাশাপাশি মুম্বইয়েও তাঁর একটি বাড়ি রয়েছে। এছাড়া দেরাদুনে রয়েছে অসাধারণ একটা বাংলো। ২০১১ সালে এই বাংলোটি তিনি ১৭.৮ কোটি টাকা দিয়ে কিনেছিলেন।ক্রিকেটার ধোনি মোটরবাইক চড়তে খুব ভালোবাসেন। 

তাঁর গ্যারাজে বেশ কয়েকটি দামি দামি বাইক রয়েছে। ধোনির বাইকের তালিকায় রয়েছে Confederate Hellcat X32, হার্লে ডেভিডসন ফ্যাট বয়, কাওয়াসাকি নিনজা এইচ ২। ধোনি প্রথম ইয়ামাহা আরডি ৩৫০ বাইকটা কিনেছিলেন। পাশাপাশি তাঁর কাছে বিলাসবহুল গাড়ির কালেকশনও রয়েছে। মাহির বাংলোয় হ্যামার এইচ ২, নিসান জোঙ্গা, Jeep Grand Cherokee Trackhawk, ল্যান্ডরোভার ফ্রিল্যান্ডার ২, অডি কিউ ৭-এর মতো গাড়িও রয়েছে। প্রত্যেকটা গাড়ির দাম প্রায় কোটি টাকা স্পর্শ করেছে।ভারতীয় ক্রিকেট দল থেকে অবসর গ্রহণ করার আগে ম্যাচ প্রতি ১ কোটি টাকা করে ফি পেতেন মাহি। আইপিএল টুর্নামেন্টে চেন্নাই সুপার কিংস ফ্র্যাঞ্চাইজি থেকে বছরে ১২ কোটি টাকা উপার্জন করেন। এছাড়া দামি দামি ব্র্যান্ড এন্ডোর্সমেন্ট এবং বিজ্ঞাপনী চুক্তি থেকেও মোটা টাকা কামিয়ে থাকেন। 

এক একটি টেলিভিশন বিজ্ঞাপনের জন্য মহেন্দ্র সিং ধোনি ৩.৫ কোটি থেকে ৬ কোটি টাকা চার্জ করে থাকেন। সূত্রের খবর, প্রতি মাসে মহেন্দ্র সিং ধোনি ৫০ কোটি টাকার বেশি উপার্জন করে থাকেন। চেন্নাই সুপার কিংস দলের অধিনায়ক মহেন্দ্র সিং ধোনির সম্পত্তি নিয়ে যদি আলোচনা করা হয়, তাহলে সেটা ইতিমধ্যেই ১,০৩০ কোটি টাকা স্পর্শ করেছে।

By Amit Kumar Basak

উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনী অমিত এখন বেসরকারী চাকুরীরত । পড়াশোনার পাশাপাশি লেখাটাও তার একটা নেশার মধ্যে পরে ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *