দশরথ মাঝি (Dashrath Manjhi – ‘The Mountain Man’) – ভারতের বিহার রাজ্যের গয়া জেলার মুহরা তহশিলের আতরি ব্লকে আছে পিছিয়ে পড়া প্রত্যন্ত গ্রাম গেহলৌর। গ্রামটিকে পাশের শহর থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে মস্ত এক পাহাড়, তার নামও গেহলৌর। পাহাড় ঘুরে ওয়াজিরগঞ্জ যেতে গ্রামবাসীকে পাড়ি দিতে হয় প্রায় ৫৫ কিলোমিটার পথ। গ্রামের উন্নয়নের পথেও একদিন প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল গেহলৌর পাহাড়। গ্রামের বাসিন্দারা তথাকথিত নিচু জাতের। তাই বিহারের জাতপাতের রাজনীতি এই গ্রামে উন্নয়নকে ঢুকতে দেয়নি। দারিদ্র, অনাহার, বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুকে নিয়তি হিসেবেই মেনে নিয়েছিলেন গ্রামবাসীরা। নেই পানীয় জল, নেই বিদ্যুৎ, নেই স্কুল বা হাসপাতালও। সবচেয়ে কাছের হাসপাতালটির দূরত্বই প্রায় সত্তর কিলোমিটার। গরুর গাড়িতে করে মূমুর্ষু রোগীকে নিয়ে যেতে যেতে কয়েক ঘন্টার মধ্যে গ্রামবাসী ফিরে আসে রোগীর মৃতদেহ নিয়ে।
হাজারো সমস্যায় জর্জরিত এ গ্রামেই শুরু হয় দশরথ ফাল্গুনির ভালোবাসার গল্প। বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন তারা। দিন মজুরের কাজ করেন দশরথ। পাহাড় বেয়ে প্রাগৈতিহাসিক সরীসৃপের মত চলে যান পাহাড়ের ওপারে। উচ্চবর্ণদের ক্ষেতে কাজ করে ফিরে আসেন সন্ধ্যের মধ্যে। দুপুরে দশরথের খাবার ও জল পুঁটলিতে নিয়ে পাহাড় বেয়ে দিয়ে আসেন ফাল্গুনি। ভীষণ ভয় লাগে তাঁর। পায়ের তলা থেকে নড়ে যায় পাথর। অনেক কষ্টে পৌঁছান দশরথের কাছে। দশরথ রোজ বারণ করেন ফাল্গুনিকে খাবার নিয়ে আসতে, শোনেন না ফাল্গুনি।
সেদিনও ফাল্গুনির জন্য অপেক্ষায় প্রহর গুনছিলেন দশরথ। কিন্তু ফাল্গুনির আসতে দেরী হওয়ায় উৎকণ্ঠা বাড়তে থাকে তার। পাহাড়ের যে পথ ধরে গ্রামবাসীরা এ মাঠে আসেন সেটি খুবই বিপদজনক। একবার পা হড়কে গেলে আর রক্ষা নেই। দুর্ঘটনার আশঙ্কা উঁকি দিতে শুরু করে দশরথের মনে। এ সময় দৌড়ে সেখানে এসে হাজির হয় গ্রামবাসীদের একজন। খবর দেয় সত্য হয়েছে দশরথের আশঙ্কাই। তার জন্য খাবার নিয়ে আসার সময় পাহাড়ে পা পিছলে ভীষণ রকম আহত হয়েছেন ফাল্গুনি। যত দ্রুত সম্ভব নিতে হবে ডাক্তারের কাছে। কিন্তু হাসপাতাল যে সত্তর কিলোমিটার দূর।
হাসপাতাল নেয়ার সময় পথেই মারা যান তিনি। এলোমেলো হয়ে যায় দশরথের নিত্যকার জীবন, হারিয়ে যায় তার জীবনের একমাত্র ভালবাসাটুকুও। পাহাড়ের বিরুদ্ধে ঘৃণা, ক্ষোভে বিষিয়ে উঠে তার অন্তর। পালের শেষ ছাগলটিও বেচে দিয়ে কিনলেন হাতুড়ি আর শাবল । এ পাহাড় যেন আর কারো প্রাণ নিতে না পারে তাই সিদ্ধান্ত নিলেন একাই এ পাহাড় কেটে রাস্তা তৈরি করবেন তিনি। এমন অসম্ভব কল্পনা কোনো পাগল ছাড়া কেউ করতে পারে না বলে হেসেই উড়িয়ে দেয় সবাই। কিন্তু দশরথ তার সঙ্কল্পে অটুট।
১৯৬০ সাল, এক ভোরে সূর্য ওঠার আগে দশরথ নেমে পড়েন প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের অসম লড়াইয়ে। হাতুড়ির ঘায়ে পাহাড়ের পাথরে দশরথ মাঝির ক্ষোভের ফুলকি ঠিকরে ওঠে। হাতুড়ির প্রতিটি আঘাত যেন স্ত্রী ফাল্গুনির মৃত্যুর প্রতিশোধ।
তার দিনমজুরির কাজ ছেড়ে দিয়ে তিনি সম্পূর্ণ রূপে মন দিলেন পাহাড় খোঁড়ার কাজে। খেয়ে না খেয়ে, রাত-দিন এক করে চলতে থাকে তার সংগ্রাম। এ সময় তিনি মাঝে মাঝে মানুষের বিভিন্ন জিনিস পাহাড় পার করে দিতেন। এ থেকে প্রাপ্ত সামান্য অর্থ দিয়েই কোনোমতে চলতো তার সন্তানদের ভরণ-পোষণ। আর চলতো দশরথের পাহাড়ের বিরুদ্ধে সংগ্রাম। এভাবে এক দিন, দু’দিন নয়, কেটে যায় বছরের পর বছর। এর মধ্যে একবার ভীষণ খরার কারণে গ্রামবাসীদের অনেকেই গেহলর ছেড়ে চলে যেতে শুরু করে। তার বাবা তাকে বোঝানোর চেষ্টা করেন তাদের সাথে শহরে চলে যাওয়ার জন্য। কিন্তু যাননি দশরথ মাঝি।
১৯৮২ সাল, শেষ পাথরটি কাটার পর দশরথ তীব্র আক্রোশে সেটি লাথি মেরে গড়িয়ে দেন ঢালু পথে। তারপর কান্নায় ভেঙে পড়েন। চোখের জলে ভিজে যায় গেহলৌরের আকাশ। আচমকাই মেঘ ভাঙা বৃষ্টি নামে। খবর পেয়ে গ্রামের লোক ভিজতে ভিজতেই ছুটে আসেন। স্থানু হয়ে দেখেন, পাহাড়ের বুক চিরে শুয়ে আছে ৩৬০ ফুট লম্বা আর ৩০ ফুট চওড়া রাস্তা। গ্রামবাসীরা দশরথকে কাঁধে তুলে নেন, দশরথ কোনও কথা বলেন না। চোখ দিয়ে বইতে থাকে জলের ধারা। রাতে যখন আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ ওঠে, দশরথ গিয়ে দাঁড়ান পাহাড়ের কোলে, সেই ছোট্ট ডোবাটির ধারে। যেখানে তাঁর প্রিয়তমার চিতা দাউ দাউ করে জ্বলে উঠেছিল কোনও এক সন্ধ্যায়।
সম্রাট শাহজাহান স্ত্রী মমতাজের জন্য তাজমহল নির্মাণ করেছিলেন। রাজ কোষাগারের অঢেল অর্থ খরচ করে, প্রায় বিশ হাজার শ্রমিক দিয়ে তৈরি হয়েছিল তার তাজমহল। পুরো পৃথিবী এখন এটিকে ভালবাসার প্রতীক হিসেবে চেনে। অন্যদিকে ফাল্গুনির প্রতি ভালবাসার জন্য গেহলরের সহায় সম্বলহীন দশরথ মাঝি বাইশ বছর ধরে একাই কেটে গেছেন পাথুরে পাহাড়। তিল তিল করে গড়ে তুলেছেন তার ‘তাজমহল’; পরবর্তীতে যার নাম হয় ‘দশরথ মাঝি রোড’। এর ফলে আগে যেখানে পৌঁছানোর জন্য মানুষের পাড়ি দিতে হতো ৫৫ কিলোমিটার পথ, এখন সেই দূরত্ব নেমে এসেছে মাত্র ১৫ কিলোমিটারে। তবে এখানেই শেষ হয়নি দশরথ মাঝির সংগ্রাম।
এ রাস্তাকে মেইন রোডের সাথে সংযুক্ত করার জন্য তিনি প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন করতে দিল্লী যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু দিল্লী যাওয়ার মতো আর্থিক সংগতি তার নেই। যে মানুষ বাইশ বছর ধরে পাহাড় ভাঙতে পারে তার কাছে এ আর এমন কি! তিনি পায়ে হেঁটেই রওয়ানা দেন বিহার থেকে দিল্লী। পথে যেতে যেতে সকল ষ্টেশন মাস্টার এর কাছ থেকে স্বাক্ষর সংগ্রহ করেন তিনি। কিন্তু দিল্লীতে গিয়ে দেখা করতে পারেননি প্রধানমন্ত্রীর সাথে।
পরবর্তীতে তিনি বিহারের প্রাদেশিক সরকার প্রধানের সাথে দেখা করেন। নিজের চেয়ার ছেড়ে উঠে দশরথ মাঝিকে সেখানে বসিয়ে সম্মান প্রদর্শন করেন রাজ্যপ্রধান নিতেশ কুমার। প্রাদেশিক সরকারের পক্ষ থেকে ৫ একর জমি দেয়া হয় তাকে। কিন্তু যার জীবনের এতটা বছর কেটে গেছে মানবতার কল্যাণে তিনি কি আর নিজের জন্য ভাবেন! সেই জমিটুকু তিনি দান করে দেন হাসপাতাল তৈরির জন্য। সেখানে এখন তার নামে গড়ে উঠেছে হাসপাতাল। ২০০৬ সালে বিহার সরকার ভারতের সবচেয়ে সম্মানজনক পদকগুলোর একটি ‘পদ্মশ্রী পদকের’ জন্য প্রস্তাব করেন দশরথ মাঝির নাম।
দশরথ মাঝির জীবন নিয়ে তৈরি হয়েছে সিনেমাও। বলিউডের প্রখ্যাত বায়োপিক নির্মাতা ‘কেতন মেহতা’ দশরথ মাঝিকে নিয়ে তৈরি করেন ‘মাঝি দ্য মাউন্টেন ম্যান’ সিনেমাটি। সেখানে দশরথ মাঝির চরিত্রে অভিনয় করেন গুণী অভিনেতা নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকী, আর তার স্ত্রীর ফাল্গুনীর চরিত্রে অভিনয় করেন রাধিকা আপ্তে। নওয়াজউদ্দিন তার অসাধারণ অভিনয় গুণ দিয়ে পর্দায় ফুটিয়ে তুলেছেন দশরথ মাঝির প্রেম-ভালবাসা আর সংগ্রামের গল্প। তবে এ সিনেমার আসল নায়ক দশরথ মাঝিই।
দেশের হাজারো সমস্যা নিয়ে আমরা যারা নিরন্তর অভিযোগ করে যাই তাদের জন্য দশরথ মাঝি এক অসাধারণ দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। গেহলর-এর মানুষ যখন পাহাড়কে নিয়তি হিসেবে মেনে নিয়েছে, কেউ আবার সরকার এর আশায় হা হুতাশ করেই ক্ষান্ত দিয়েছে, তখন দশরথ মাঝি কারো প্রতি কোনো অভিযোগ করেননি। সরকারের আশায়ও বসে থাকেননি। নিজেই হাতে তুলে নিয়েছেন হাতুড়ি,শাবল। বছরের পর বছর কাজ করে গেছেন মানুষের কল্যাণের জন্য।
আপনজনকে হারিয়ে একটা পাহাড়ি মানুষ জীবনের গল্প লেখা শুরু করেছিলেন। পাহাড়ের মতোই দৃঢ় ছিল তাঁর সংকল্প। নিজের আত্মবিশ্বাস ও সাহসকে পাথেয় করেই এগিয়েছিলেন দশরথ মাঝি। প্রকৃতি, জীবন সবকিছুতে পাহাড়ের ভূমিকা এমনই। দৃপ্ত, কঠিন, সারল্যে ভরা, যাকে প্রত্যাখ্যান করা যায় না। ২০০৭ সালে গলব্লাডারের ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান এই প্রত্যয়ী পাহাড়ি মানুষটি।