জয়নগরের মোয়া তৈরীর ইতিহাস (History of Jaynagar’s Moa) : বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণে শীত আর বাদ যায় কেন! শীতের আমেজও চেটেপুটে উপভোগ করতে চায় খাদ্য রসিক বাঙালি। শীতকালে বাঙালির প্রিয় হচ্ছে নলেন গুর আর মোয়া। প্রায় ১০০ বছর ধরে তার ঐতিহ্য বহন করে চলেছে জয়নগরের মোয়া।শীতকালে মোয়া পেটে না পড়লে মনে হয় কিছু একটা বাদ যাচ্ছে । কাঁচের শো-কেসের ওপর পেল্লাই সাইজের এক রঙ্গিন হাঁড়ি। সরা দিয়ে মুখ বন্ধ। ভিতরে অমৃতের স্বাদ। মিষ্টির দোকানে ক্রেতার ভিড় জমাতে শুধু ‘জয়নগরের মোয়ার ’ নামই যথেষ্ট। শহর এবং শহরতলীতে শীতের আমেজ আসতে শুরু করলেই শীতের স্পেশাল মিষ্টির দোকান যত্রতত্র গজিয়ে ওঠে। গুড় পাটালী সঙ্গে থাকলেও প্রধান আকর্ষণ কিন্তু জয়নগরের মোয়া। মুখে দিলে মিলিয়ে যায়, আঙুলে গন্ধ লেগে থাকে। গুড় থেকে মাখা খই, প্রজন্মের পর প্রজন্মকে মাতিয়ে রেখেছে স্বাদে। নামে গুড় মাখা খই হলেও আসলে ব্যপারটা বেশ মহারাজকীয়।এই মোয়া আবিষ্কার হয় জয়নগর শহরের নিকটবর্তী বহরু গ্রামে।
ইতিহাস অনুসারে জনৈক যামিনী বুড়ো তার বাড়ির একটি অনুষ্ঠানে নিজের খেতে উৎপাদিত কনকচূড় ধানের খই ও নলেন গুড় দিয়ে মোয়া প্রস্তুত করে পরিবেশন করে সবাইকে । এমন জিনিস আগে কেউ খায়নি। খাওয়ার পর ধন্য ধন্য পড়ে গেল চারিদিকে। এভাবেই জন্ম নিল মোয়া। আজ্ঞে, জয়নগরে নয়। দুই বন্ধু পূর্ণ চন্দ্র ঘোষ (ওরফে পূর্ণ) এবং নিত্যগোপাল সরকার (ওরফে বুচকি) স্থানীয় সাপ্তাহিক বাজারে মোয়া বিক্রি শুরু করেন এবং এটি বুচকির মোয়া নামে পরিচিত হয়, যা পরে জয়নগরের মোয়া নামে পরিচিত হয়। ১৯২৯ সালে বুচকি এবং নিত্য জয়নগর মজিলপুর রেলওয়ে স্টেশনের কাছে জয়নগর মজিলপুর টাউনে শ্রী কৃষ্ণ মিষ্টান্ন ভান্ডার নামে তাদের নিজস্ব মিষ্টির দোকান স্থাপন করেন । দোকানটি এখনও চালু আছে এবং পূর্ণ চন্দ্র ঘোষের নাতনী দ্বারা পরিচালিত হয়।
মোয়ার জন্মস্থান এই গ্রামের ইতিহাসও মোটে হেলাফেলার নয়। রায়মঙ্গল কাব্যে উল্লেখ মেলে ‘বড়ুক্ষেত্রে’র। এই বড়ুক্ষেত্রই বহরু। উনিশ শতকের শুরুতে এই গ্রামের জমিদারি পান নন্দকুমার বসু। তিনি ঠিক করেন এই বহরুতেই মথুরা-বৃন্দাবন স্থাপন করবেন। সেই ইচ্ছে অনুযায়ী, বহরুতেই তৈরি হয় শ্যামসুন্দরের মন্দির। সেই মন্দিরের গায়ে দেওয়ালচিত্র এঁকেছিলেন প্রখ্যাত শিল্পী গঙ্গারাম ভাস্কর। এই বহরুতেই ছোটোবেলা কেটেছে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় এবং শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের। আর, এসবের পাশাপাশি রত্নগর্ভা এই গ্রামই জন্ম দিয়েছিল বাঙালির অতিপ্রিয় খইয়ের মোয়ার।
যামিনীবুড়োর তৈরি সেই মোয়ায় অবশ্য খই আর নলেন গুড় ছাড়া উপকরণ বলতে আর কিছুই ছিল না। সেই মোয়াকে আজকের আদল দিলেন দুই বন্ধু জয়নগরের পূর্ণচন্দ্র ঘোষ ওরফে বুঁচকিবাবু আর নিত্যগোপাল সরকার। দুজনে মিলে ঠিক করলেন এই মোয়া তৈরি করে বিক্রি শুরু করবেন। এতদিন হাটুরে, চাষী, গেরস্তরা ইচ্ছে হলেই খই, গুড় মেখে মুখে পুরে দিতেন। এবারে শুরু হল সেই মোয়ারই বাণিজ্যিক উৎপাদন। মোয়াতে মিশল গাওয়া ঘি, খোয়া ক্ষীর। খই আর গুড়ের জুটিও আরো অন্তরঙ্গ হল। ‘শ্রীকৃষ্ণ মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে’ সেই শুরু হল মোয়ার ‘জয়নগর’ তকমার আড়ালে পথচলা শুরু।
এবার কালক্রমে জয়নগরের মোয়া এমনই বিখ্যাত হয়ে উঠল যে তার নামের ভারে ধামাচাপা পড়ে গেল জন্মদাত্রী বহরুর নাম। এই ৯০ থেকে ৯৫ বছরে জয়নগর-মজিলপুরেই গজিয়ে উঠেছে প্রায় আড়াইশোটি মোয়ার দোকান। তবে, জয়নগর স্টেশনের ১ নম্বর প্ল্যাটফর্মের বাইরে বাসরাস্তার পাশে ‘শ্রীকৃষ্ণ মিষ্টান্ন ভাণ্ডার’ আজো দাঁড়িয়ে। আজো এই দোকানের খ্যাতি বুঁচকিবাবুর দোকান হিসেবেই। কিন্তু, স্বাদের খ্যাতিতে এই দোকানকেও এখন টেক্কা দিচ্ছে কমলা মিষ্টান্ন ভাণ্ডার, পঞ্চানন মিষ্টান্ন ভাণ্ডার বা রামকৃষ্ণ মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের মোয়া।
সাধারণত কোয়ালিটির ফারাকে মোয়ার দামেরও হেরফের হয়। দেড়শো টাকা কেজি থেকে দাম পৌঁছতে পারে পাঁচশো-সাড়ে পাঁচশো টাকা কেজিতেও। এক-এক কেজিতে কুড়িটি করে মোয়া। খাঁটি জয়নগরের মোয়ার ক্ষেত্রে খই আর গুড়ের রসায়নটাই আসল হয়ে দাঁড়ায়। খই মানে কনকচূড়। বাংলায় মরিশাল নামে আরেক রকমের খইয়ের ধানও চাষ হয়। স্বাদে, গন্ধে কনকচূড়ের থেকে ঢের পিছিয়ে এই ধান। অথচ, কলকাতা ও শহরতলির বাজারে ‘জয়নগরের মোয়া’ তকমার আড়ালে গিজগিজ করছে এই মরিশাল খইয়েরই মোয়া। একইসঙ্গে, আসল নলেন গুড় পাওয়াও দুষ্কর হয়ে উঠেছে এখন। উৎকৃষ্ট মোয়ার জন্য প্রয়োজন খাঁটি নলেন গুড়। খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহ করে তিন দিন রেখে দেওয়ার পর, সেই রস সামান্য আঁচে জ্বাল দিয়ে তৈরি হয় নলেন গুড়। এই নলেন গুড় আর কনকচূড়ের গুণমানে খামতি হলে প্রয়োজন পড়ে কৃত্রিম রং, ফ্লেভারের। যাঁরা রসিক, তাঁদের জিভ দিব্যি ধরতে পারে সেই ‘নকল’ স্বাদ। অতএব, আসল মোয়া চাখতে গাঁটের কড়ি ফেলতেই হবে। সেই জন্যেই কেজি প্রতি মোয়ার দাম পাঁচশোও ছাপিয়ে যায় ।
দক্ষিণ জেলা কাকদ্বীপ, নামখানা, ডায়মন্ড হারবার, গঙ্গাসাগর এলাকায় প্রচুর পরিমাণে কনকচূড় ধানের চাষ হয়। সেই ধানের খই মোয়ার কাজে ব্যবহৃত করা হয়। আর শীতকালে কৃষ্ণনগর, নদীয়া, সুন্দরবনের বেশিরভাগ খেজুর গাছকে এই রসের জন্য ব্যবহৃত করা হয়। অর্থাৎ খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহ করে রাখা হয় তার রস জাল দিয়ে তৈরি হয় গুড়। সেই গুড় খই সাথে মিশানো হয়। তার সঙ্গে প্রসিদ্ধ গাওয়া খাঁটি ঘি কাজু ,কিসমিস ব্যবহৃত হয়।
হেমন্ত শেষ হতে না হতেই মোয়া তৈরির মরসুম শুরু হয়ে যায় জয়নগর-মজিলপুর-বহরুর বিস্তীর্ণ অঞ্চলে। অসংখ্য পরিবারের সারা বছরের রোজগার এই কয়েক মাসের মোয়া তৈরি ও বিক্রি থেকেই উঠে আসে।চাহিদা বাড়লেও দাম ঊর্দ্ধমুখী হয় মাঝেমাঝেই।
জয়নগরের মোয়ার আধিপত্যে কীভাবে যেন বিস্মৃতির আড়ালে চলে গেছে মোয়ার আবিষ্কর্তা যামিনীবুড়োর গ্রাম বহরু। যদিও, বহরুর মোয়া স্বাদে কিন্তু মোটেও পিছিয়ে নেই জয়নগরের মোয়ার থেকে। বহরু বাজারের ওপরেই ‘শ্যামসুন্দর মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের’ মোয়া তো বিখ্যাত। প্রায় একই উপাদান, কিন্তু জয়নগরের মোয়ার থেকে বহরুর মোয়া যেন কিঞ্চিৎ নরম। জয়নগরের মোয়ায় ক্ষীরের আধিক্য সামান্য বেশি, আর বহরুর মোয়ায় গুড়ের। স্বাদের বিচারে কে সেরা— তা নিয়ে অবশ্য রসিকদের মধ্যে বিবাদের শেষ নেই।
২০১৬ সালে বাংলার মোয়া জিআই স্বীকৃতি পেয়েছিল। তবু মোয়াশিল্পে মন্দা দেখা দিয়েছে । খেজুর গাছ কমতে থাকা, তার অন্যতম কারণ।
বর্তমানে নকল উপাদানে তৈরি সস্তার মোয়া বাজার দখল করে নেওয়ায় ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে আসল মোয়ার কারিগর এবং ব্যবসায়ীরা। তারপরে জয়নগর-বহরুর খাঁটি মোয়ার স্বাদে সিংহভাগ বাঙালিই কিন্তু বঞ্চিত। অথচ, বাজার ভরে আছে নকল ‘জয়নগরের মোয়ায়’। চৌকো বাক্স, বাক্স খুললেই হলুদ পাতলা পলিথিনের ভিতর থেকে যে নিরীহ মোয়ারা উঁকি মারে, তাদের জন্মস্থল জয়নগরের ধারেকাছেও নয়। উপকরণ, স্বাদ— খামতি সবদিকেই। উপায় নেই, তাই জেনে-বুঝেই কনকচূড়, আসল নলেন গুড়, খয়া ক্ষীর, পেস্তা, এলাচের সেই মধুমণ্ডের বদলে ‘জয়নগরের মোয়া’র তকমা সাঁটা মরীচিকার দিকেই বারবার ছুটে যাই আমরা। আর এভাবেই বাজারে আরো জাঁকিয়ে বসছে ছদ্মবেশী ‘জয়নগরের মোয়া’রা |