Effects of Global Warming

গ্লোবাল ওয়ার্মিং বা বৈশ্বিক উষ্ণতা (Global Warming) : বর্তমান পৃথিবীর বয়স ৫৪ বিলিয়ন বছর। আর বহুকাল থেকেই আমাদের এই পৃথিবীতে মানুষসহ বিভিন্ন জীবজন্তু বসবাস করে আসছে। কালের বিবর্তনে বর্তমানে মানুষ এই পৃথিবীকে পরিচালনা করছে। কিন্তু বেঁচে থাকার তাগিদে মানুষের কর্মকান্ড পৃথিবীতে এক অন্যরকম বিপর্যয় নিয়ে আসছে। পৃথিবী দিন দিন যেমন বাস অনুপযোগী হয়ে যাচ্ছে, তেমনি পৃথিবী ধ্বংসের দিকে চলে যাচ্ছে। এর মূল কারণ গ্লোবাল ওয়ার্মিং।

গ্লোবাল ওয়ার্মিং মূলত ইংরেজি শব্দ Global Warming । বাংলা অর্থ হলো বৈশ্বিক উষ্ণায়ন। অর্থাৎ এক কথায় বলতে গেলে, মানুষের কিছু কর্মকাণ্ডের কারনে পৃথিবীর তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়াকেই মূলত বৈশ্বিক উষ্ণায়ন বলা হচ্ছে। বিজ্ঞানীরা ইতিমধ্যে আমাদেরকে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন সম্পর্কে পুরোপুরি ধারণা দিয়েছেন এবং একই সাথে সতর্ক করে দিচ্ছেন এর সুদূর প্রসারি প্রভাব সম্পর্কে।

গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর বিভিন্ন কারণ রয়েছে। আমাদের বিভিন্ন ক্রিয়াকলাপ এর ফলে বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইড (CO2), মিথেন (CH4) এবং নাইট্রাস অক্সাইড (N2O) এর মতো গ্রিনহাউস গ্যাসগুলোর নির্গমন বৃদ্ধি পাচ্ছে। একে Green House Effect বলা হয়। এই গ্যাসগুলি তাপকে আটকে রাখে এবং পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে অবদান রাখে।

এমন আরো কিছু কারনের মধ্যে রয়েছে –

  • শক্তির উৎপাদনের জন্য জীবাশ্ম জ্বালানী পোড়ানো,
  • বন উজাড় করা,
  • শিল্প কল-কারখানা সংখ্যা বৃদ্ধি এবং
  • অবৈজ্ঞানিক কৃষি পদ্ধতি
Air Pollution

গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর প্রভাব

আমাদের পরিবেশের উপর গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর ব্যাপক প্রভাব রয়েছে । নিচে পর্যায়ক্রমে আলোচনা করা হলো –

জলবায়ু পরিবর্তন

বিগত কয়েক দশকের তথ্য বিশ্লেষণের মাধ্যমে দেখা যাচ্ছে যে বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে পৃথিবীব্যাপী আবহাওয়া ও জলবায়ুর পরিবর্তন শুরু হয়েছে। এই জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাব পৃথিবীর প্রতিটি দেশের উপর পড়ছে। যেমন –  ১৯৯০ এর দশকে পৃথিবীর উষ্ণতম বছর গুলি পরিলক্ষিত হয়, যার মধ্যে ১৯৯৫ সাল পৃথিবীর সবচেয়ে উষ্ণতম বছর। সাইবেরিয়ার বেশির ভাগ অংশের তাপমাত্রা পূর্ববর্তী শতক গুলির তুলনায় ৩ থেকে ৫  ডিগ্রি সেলসিয়াস উষ্ণতা বৃদ্ধি পেয়েছে।  ১৮৫০ সালের পর থেকে ইউরোপের আল্পস পর্বতের অর্ধেক বরফ গলে গিয়েছে। মেরু অঞ্চলে সমুদ্রের জলের উষ্ণতা বৃদ্ধি পাওয়ায় আন্টার্কটিকায় পেঙ্গুইনের সংখ্যা কমে গেছে এবং ক্রিল জাতীয় একপ্রকার সামুদ্রিক প্রানী যাদের বিভিন্ন সামুদ্রিক প্রানীরা খাদ্য হিসাবে গ্রহন করে তাদের পরিমানও কমে গেছে।

ক্রান্তীয় অঞ্চল গুলি আরো উষ্ণ ও শুষ্ক হচ্ছে, কৃষিকাজ ব্যহত হচ্ছে ও জলের অভাব দেখা যাচ্ছে। মঙ্গোলিয়ার গোবি মরু অঞ্চলে গ্রীষ্মকালীন বৃষ্টিপাতের পরিমান বিগত ৩০ বছর ধরে ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে। ভূমধ্যসাগরীয় জলবায়ু অঞ্চলেও বৃষ্টিপাত পূর্বের তুলনায় অনেক কমে গেছে।

হিমবাহের গলন

মেরু অঞ্চলে যে হিমবাহের চুড়া গুলি হাজার হাজার বছর ধরে অক্ষত অবস্থায় ছিল আজ সেই বরফ চাঁই গুলি বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে অতি দ্রুত গলিত হয়ে যাচ্ছে।মেরু অঞ্চল গুলিতে শীতকালীন বরফ সঞ্চয়ের পরিমান অনেকটা হ্রাস পেয়েছে এবং যে পুরু বরফের স্তর গুলি সৃষ্টি হয়েছিল সেগুলি গ্রীষ্মের আগমনের সাথে সাথেই গলে যাচ্ছে। আন্টার্কটিকার বহু বছর ধরে সঞ্চিত হয়ে থাকা বিশাল বিশাল বরফের স্তূপ গুলি আজ অতি সহজেই ভেঙ্গে যাচ্ছে। গ্রিনল্যান্ড ও আন্টার্কটিকার মধ্যভাগে বরফ পাতের পরিমান বৃদ্ধি পেলে বিশ্ব উষ্ণায়নের জন্য এই দুই জায়গায় বরফের চাদর গুলি ক্রমশ সংকুচিত হয়ে পড়ছে।

Glacier

সমুদ্র জলের উচ্চতা বৃদ্ধি

বিশ্ব উষ্ণায়নের জন্য মেরু অঞ্চলে সঞ্চিত থাকা বরফ চূড়া গুলি অতি দ্রুত গলে যাচ্ছে, যার ফলে সমুদ্র জলের উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। IPCC এর মতে বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে আগামী ১০০ বছরের মধ্যে সমুদ্র জলের উচ্চতা ২০ থেকে ৮০ সেমি মতো বৃদ্ধি পাবে। সমুদ্র জলের উচ্চতা বৃদ্ধি উপকূলীয় অঞ্চলে মানুষজন এবং তাদের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও পরিবেশগত ভয়াবহতার সৃষ্টি করছে। সমুদ্র জল পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির প্রাথমিক প্রভাব হল উপকূলীয় অঞ্চলে বন্যা, ভূমিক্ষয়, সমুদ্র তরঙ্গ ও ঘূর্নিঝর জনিত জলোচ্ছ্বাসের পরিমান বৃদ্ধি। যার ফলে উপকূলীয় বাস্তুতন্ত্র যেমন জলাভূমির সমুদ্র জলে নিমজ্জন , উপকূলীয় অঞ্চলের স্বাভাবিক উদ্ভিদ ও বাসস্থানের অবলুপ্তি, ভৌমজলের মধ্যে সামুদ্রিক নোনা জলের প্রবেশ এবং কৃষিজাত জমির অভাব পরিলক্ষিত হয়।    

আগামী  এক শত বছরে সমুদ্র জলের উচ্চতা যে পরিমান বাড়বে বলে অনুমান করা হয়েছে, সেই পরিমান উচ্চতা বৃদ্ধি পেলে সমুদ্র মধ্যবর্তী দ্বীপ যেমন মালদ্বীপ, মার্শাল দ্বীপ যেগুলি সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে মাত্র ২ থেকে ৪ মিটার পর্যন্ত উঁচু সেগুলি সম্পূর্ন ভাবে সমুদ্রতলে নিমজ্জিত হয়ে যেতে পারে। দক্ষিণ- পূর্ব এশিয়ার দেশ গুলির উপকূলবর্তী অঞ্চল গুলিতেই সবচেয়ে বেশি মানুষ বসবাস করে, সেই মানুষ গুলিও একটি বিরাট সমস্যার সম্মুখিন পর্যন্ত হতে পারে।

Pollution

বন্যার প্রাদুর্ভাব বৃদ্ধি

বিশ্ব উষ্ণায়ন জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটিয়ে জলবায়ু সম্পর্কীত দূর্যোগ, যেমন – ঝড়, বন্যা প্রভৃতির পরিমান বাড়িয়ে দেয়। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় পৃথিবীর প্রায় দুই-পঞ্চমাংশ মানুষ মৌসুমি বায়ুর প্রভাবিত অঞ্চলে বসবাস করে আর এই মৌসুমি বায়ুর উৎপত্তির প্রধান কারণ সমুদ্র ও স্থলভাগের উষ্ণতার পার্থক্য। বিশ্ব উষ্ণায়নের জন্য স্থলভাগ দ্রুত উত্তপ্ত হয়ে স্থল ও জলভাগের উষ্ণতার তারতম্য সৃষ্টি করছে আবার এই উষ্ণায়নের জন্য মৌসুমি বায়ুর জলধারণ ক্ষমতাও বৃদ্ধি পাচ্ছে।

এল নিনো সৃষ্টি ও পৃথিবীব্যাপী তার প্রভাব

স্পেনীয় শব্দ ‘El Nino’ কথার অর্থ Christ Child বা শিশু খ্রীষ্ট । বিশ্ব উষ্ণায়নের প্রভাবে ক্রান্তীয় প্রশান্ত মহাসাগরের পূর্বভাগে পেরু ও ইকুয়েডরের পশ্চিম উপকূল দিয়ে কোনো কোনো বছর খ্রিষ্টমাসের সময় প্রচন্ড উষ্ণ সমুদ্রস্রোত প্রবাহের ফলে আবহাওয়ার যে অস্বাভাবিক পরিবর্তন ঘটে, তাকে এল নিনো বলা হয় । এল নিনোর প্রভাবে, পূর্ব আফ্রিকা ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশসমূহে আর্দ্র দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর আগমন বাধাপ্রাপ্ত হয়ে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমে । ফলে খরা পরিস্থিতির উদ্ভব হয় । পৃথিবীর পশ্চিম গোলার্ধের উষ্ণতা স্বাভাবিকের তুলনায় বৃদ্ধি পায় । (iii) দক্ষিণ আমেরিকার পেরু উপকূলে সামুদ্রিক মৎস্যের আহরণ উল্লেখযোগ্যভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ।

জাতিসংঘের বৈশ্বিক উষ্ণতা বিষয়ক আন্তঃ সরকার প্যানেলের (আইপিসিসি) গবেষণায় দেখা যায়, আমাদের গ্রহটি ১২ বছরের মধ্যে তাপমাত্রা বৃদ্ধির চূড়ান্ত সীমা ১.৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস অতিক্রম করতে পারে। যেটা কিনা প্রাক-শিল্পযুগের মাত্রার থেকেও বেশি।

এতে করে আবহাওয়া পরিস্থিতি অস্বাভাবিক রূপ নেবে বিশেষ করে চরম দুর্ভিক্ষ, দাবানল, বন্যা সেইসঙ্গে লাখ লাখ মানুষের খাদ্য সংকটের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেবে। তাপমাত্রার এই সীমা অতিক্রম এড়াতে, বিশ্বের উচিত, সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে দ্রুত, সুদূরপ্রসারী ও নজিরবিহীন পরিবর্তন আনা।

By Amit Kumar Basak

উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনী অমিত এখন বেসরকারী চাকুরীরত । পড়াশোনার পাশাপাশি লেখাটাও তার একটা নেশার মধ্যে পরে ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *