Sheikh Mujibur Rahman

শেখ মুজিবুর রহমান (Sheikh Mujibur Rahman): জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান (১৯২০ – ১৯৭৫) স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি। ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার (বর্তমানে জেলা) টুঙ্গিপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পিতা শেখ লুৎফর রহমান ছিলেন গোপালগঞ্জের দেওয়ানী আদালতের সেরেস্তাদার।

শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৪২ সালে গোপালগঞ্জ মিশনারি স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন, ১৯৪৪ সালে কলকাতার ইসলামিয়া কলেজ থেকে আইএ (দ্বাদশ শ্রেণী) এবং ১৯৪৭ সালে একই কলেজ থেকে বিএ পাস করেন।

অল্প বয়স থেকেই তার মধ্যে রাজনৈতিক প্রতিভার বিকাশ ঘটতে থাকে । ১৯৪০ সালে তিনি নিখিল ভারত মুসলিম লীগের ছাত্র সংগঠনের সদস্য হন । পরে কট্টরপন্থী এই সংগঠন ছেড়ে তিনি যোগ দেন উদারপন্থী বেঙ্গল মুসলিম লীগে । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় তিনি প্রতিষ্ঠা করেন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগ। পরবর্তীতে এই লীগ ই হয়ে ওঠে তার ভাষা আন্দোলনের অন্যতম সহযোগী ।

পঞ্চাশের দশক ছিল তার রাজনৈতিক উত্থানের সময় । এই সময় তিনি মুসলিম লীগ ছেড়ে দেন এবং গঠন করেন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ । এরপর তিনি নির্বাচনে অংশ নেন এবং ভোটে নির্বাচিত হয়ে ১৯৫৪ সালে বাংলাদেশের কৃষিমন্ত্রী হন । তিনি ছিলেন আয়ুব খানের মৌলিক গণতন্ত্র তত্ত্বের কট্টর সমালোচক । ১৯৬৬ সালে, তিনি তার বিখ্যাত ছয় দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন, এটিকে ‘আমাদের [বাঙালিদের’] বেঁচে থাকার সনদ’ নামে অভিহিত করেন, যার লক্ষ্য ছিল পূর্ব পাকিস্তানের স্ব-শাসন। পশ্চিম পাকিস্তানি আধিপত্যের শিকড়ে তীক্ষ্ণ আঘাত করে, ছয় দফা কর্মসূচী একযোগে জাতির দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তার ছয় দফা কর্মসূচিতে জনগণের ব্যাপক সমর্থনে ভীত হয়ে ততকালীন পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী তত তাকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় তাকে গ্রেফতার করে । পরে জনরোষের চাপে পড়ে পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী তাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।

মুক্তির পরের দিন সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ (সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ) তাকে রমনা রেসকোর্সে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) গণসংবর্ধনার আয়োজন করে এবং তাকে ‘বঙ্গবন্ধু’ (বাঙালির বন্ধু) উপাধিতে ভূষিত করে।

১৯৬৯ সালের এক সমাবেশে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের নামকরণ করেন বাংলাদেশ । শেখ মুজিবের এই স্বায়ত্বশাসনের ধারণা পাকিস্তানি শাসক দলকে বেশ অস্বস্তিতে ফেলেছিল । তারা বিভিন্ন ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধচারণ শুরু করেন । রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান একতরফাভাবে ১৯৭১ সালের ৩রা মার্চ ঢাকায় অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় পরিষদের বৈঠক বাতিল করেন।শেখ মুজিবুর রহমান তখনই বুঝতে পারেন যে স্বতন্ত্রতার জন্য লড়াইয়ের কোনো বিকল্প নেই । বঙ্গবন্ধু পূর্ব পাকিস্তানে সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। সমগ্র প্রদেশ অসহযোগ আন্দোলনকে সমর্থন করে।অসহযোগের সময় ( ২ – ২৫শে মার্চ ১৯৭১ ) পূর্ব পাকিস্তানের সমগ্র বেসামরিক কর্তৃপক্ষ শেখ মুজিবুর রহমানের নিয়ন্ত্রণ ও নির্দেশের অধীনে আসে, তিনি নিজেই প্রদেশের প্রকৃত সরকার প্রধান হন। এই সময়ে, ৭ই মার্চ মুজিব রেসকোর্সে এক বিশাল জনসমাবেশে একটি ঐতিহাসিক ভাষণ দেন যা বাঙালি জাতির ইতিহাসে এক সন্ধিক্ষণ হিসেবে চিহ্নিত করে। এদিকে, জেনারেল ইয়াহিয়া খান এবং পশ্চিম পাকিস্তানের অন্যান্য নেতারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও তার দলের সাথে আলোচনা শুরু করার জন্য ১৫ই মার্চ ঢাকায় আসেন।পরের দিন আলোচনা শুরু হয় এবং ২৫ শে মার্চ সকাল পর্যন্ত বিরতিহীনভাবে চলতে থাকে। এ সময় নিরলসভাবে অসহযোগ ও হরতাল চলতে থাকে।

আলোচনা বিফলে যাওয়ার পর ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ২৫শে মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ঢাকা শহরে গণহত্যা চালায়। ফলশ্রুতিতে, তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। একই রাতে তাকে গ্রেফতার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়। ব্রিগেডিয়ার রহিমুদ্দিন খানের সামরিক আদালত তাকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করলেও তা কার্যকর করা হয়নি। নয় মাসব্যাপী রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ শেষে ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশ-ভারত যৌথ বাহিনীর কাছে পাকিস্তান সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করার মধ্য দিয়ে বিশ্ব মানচিত্রে “বাংলাদেশ” নামক স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে। ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের ১০ই জানুয়ারি শেখ মুজিব পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন এবং বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এরপর যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে পুনর্গঠনের জন্য তিনি দিন রাত নিরলস পরিশ্রম শুরু করেন । বিপর্যয় মোকাবিলা করতে তিনি আন্তর্জাতিক সাহায্য দাবি করেন । অল্প সময়ের মধ্যেই সাহায্য আসতে শুরু করলে শুরু হয় বাংলাদেশ পুনর্গঠনের লড়াই । এই সময় হঠাৎ ই কিছু স্বাধীনতা বিরোধী চক্র সক্রিয় হয়ে ওঠে । তিনি বুঝতে পারলেন এইসময় রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ছাড়া দেশে উন্নয়ন সম্ভব নয় । ১৯৭৪ সালে তিনি সমস্ত রাজনৈতিক দলকে এক ছাতার তলায় আনতে প্রতিষ্ঠা করেন বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ। ধীরে ধীরে বাংলাদেশে স্থিতিশীলতা আসতে শুরু করে । এত বাধা বিপত্তি কাটিয়ে বাংলাদেশ যখন ঘুরে দাঁড়াচ্ছিল তখন আসে আরেকটা আঘাত। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট একদল অসন্তুষ্ট সেনা কর্মকর্তা হত্যা করে শেখ মুজিবুর এবং তার পুরো পরিবার কে । কেবলমাত্র তার দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা সেই সময় বিদেশে থাকার জন্য বেঁচে যান। তার মৃত্যুতে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের অপূরণীয় ক্ষতি হয় । থমকে যায় বাংলাদেশের রাজনৈতিক উন্নয়নের ধারা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *