Artificial IntelligenceArtificial Intelligence

আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স / কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (Artificial Intelligence (AI) ) : সভ্যতার অগ্রগ্রতির সঙ্গে প্রযুক্তিগত উন্নতি ঘটেছে। আর সেই প্রযুক্তির অগ্রগতির সঙ্গে যে বিষয়গুলির চাহিদা বাজারে রীতিমতন বেড়ে গেছে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টালিজেন্স তার মধ্যে অন্যতম।কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তথা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের (এআই) জয়জয়কার এখন বিশ্বময়। উন্নত বিশ্ব এখন আরও বেশি ঝুঁকছে এই প্রযুক্তির দিকে।বর্তমানে বিশ্বে এমন কোনও ক্ষেত্র নেই, যেখানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্য নেওয়া হয় না। স্বাস্থ্যক্ষেত্র, শিক্ষা থেকে শুরু করে ব্যবসা ও অটোমোবাইল পর্যন্ত সমস্ত ক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, শুধু কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সঠিক প্রয়োগে আগামী ২০৩০ সালের মাঝে বিশ্ব অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার বেড়ে ১৬ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারে দাঁড়াবে। নানা ক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার আমাদের জীবনকেও তাই আগের চেয়ে অনেক সহজ করে তুলেছে। এ ছাড়া, বেড়েছে এই বিষয় সম্পর্কিত চাকরির সুযোগও, যেখানে বেতন কাঠামো আকর্ষণীয়। তাই এ বার ঝটপট চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক এই বিষয়ের নানা দিকে।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স হলো এমন একটি প্রযুক্তি, যা তথ্য বিশ্লেষণের মাধ্যমে যন্ত্র বা অ্যাপ্লিকেশনকে মানুষের বুদ্ধি ও চিন্তাশক্তির আদলে কাজের উপযোগী করে তোলে।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ইতিহাস

মানুষের মস্তিস্কের মতো চিন্তাভাবনা করার যন্ত্র আবিষ্কারের আসল বাজিমাত শুরু হয় ১৯৪০ এর দশকের দিকে, ঠিক কম্পিউটার আবিষ্কারের সাথে সাথে। তখন থেকেই মানুষ যে তাদের মতো যন্ত্র বানানোর লাল-নীল স্বপ্ন দেখত তার বাস্তব রূপ দেওয়ার কিছুটা ভরসা খুঁজে পায় এবং বিষয়গুলোকে গুরুত্ব সহকারে আরও এগিয়ে নেওয়ার দিকে মনোযোগী হয়। মজার বিষয় হল তখনও এই ধরনের যন্ত্র/প্রক্রিয়ার কোন নাম মানুষের মাথায় আসে নাই।বিজ্ঞানীরা আমাদের মস্তিস্কের কর্মপদ্ধতি দেখে উৎসুক হতে থাকেন মেশিনকেও এমনভাবে কাজ করানোর জন্য। ভাবুক এবং বিজ্ঞানী মানুষগণ এইগুলো নিয়ে অনেক কাজ করতে থাকেন। ১৯৫০ সালে এলান টুরিং(Alan Turing) নামে এক ইংরেজ ভদ্রলোক খুব মজার একটি টেস্ট আবিষ্কার করেন যা Turing’s Test নামেই পরিচিত।বেচারি বলেন-“কোন একজন মানুষ একটি যন্ত্রের সাথে কথা/চ্যাট করতে শুরু করলে যদি মানুষটি বুঝতে না পারে যে অপরপ্রান্ত থেকে যে কথা বলছে সে মানুষ না যন্ত্র তা হলেই বুঝতে হবে ওই যন্ত্রটির বুদ্ধি আছে।” আমার কাছে মনে হয় এটি আসলেই যুগান্তকারী একটা টেস্ট।

১৯৫৬ সালে মারভিন মিনস্কি, জন ম্যাকার্থি, ক্লাউড শ্যানন এবং নাথান রচেস্টার Dartmouth College এ কনফারেন্সের আয়োজন করেন। এই কনফারেন্সে এও বলা হয় যে, মানুষের শিক্ষার ধরণ, বুদ্ধি-বিবেক অবিকল মানুষের মতো মেশিনও প্রয়োগ করা সম্ভব। কনফারেন্সে সবাই বেশ উজ্জীবিত হয় এবং অনেকে কয়েক লক্ষ মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করে। সবাই মিলে এই ফিল্ডের নামArtificial Intelligence রাখতেও সম্মত হয়। আর জন্ম নেই নতুন এক আবিষ্কারের ক্ষেত্র যা মেশিনকে মানুষের মতো বানাবে। মানুষ আশানুরূপ সাফল্য পেতেও শুরু করে। পরবর্তীতে ছোটখাটো আলজেব্রিক সমস্যা সমাধান, জ্যামেতিক প্রমান করা, ইংরেজিতে কথা বলতে পারা ইত্যাদি অনেক কাজই করতে সক্ষম হয়।কেউ কেউ তো ভাবতেই শুরু করেছিল পুরোপুরি মানুষের মতো বুদ্ধিমান যন্ত্র মনে হয় কিছু দিনের মধ্যেই চলে আসবে। আর সবগুলিই হয়েছিল AI এর সোনালী যুগে (১৯৫৬-১৯৭৪) সালের মধ্যে।

একেবারে দ্রুত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছিল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। এই উন্নতিগুলো দেখে আমেরিকার মিলিটারী এজেন্সিসহ অনেকেই ফান্ডিং দেওয়া শুরু করে। একপর্যায়ে স্বল্প প্রসেসিং পাওয়ার, হার্ডওয়্যার ইত্যাদি কারণে গবেষকগণ আশানুরূপ অগ্রগতি পাচ্ছিলেন না। তখন যারা ফান্ডিং করেছিল তারা ভাবল যা ইনভেস্ট করছি সবই জলে গেল। এই ভেবে দিল ফান্ডিং বন্ধ করে।এতে যা হবার তাই হল সব ধরনের অগ্রগতি বন্ধ হয়ে গেল। প্রায় সাতটি বছর কোন অগ্রগতি হয়নি। ১৯৮০ সালে আবার হাটি-হাটি পা-পা করে অগ্রযাত্রা শুরু হয়। আশির দশকের শেষের দিকে আবার হোঁচট খাই। কারণ এত বেশি পরিমাণ তথ্য প্রসেস করার মতো যন্ত্র তাদের ছিল না। কম্পিউটারের ক্ষমতা যখন বেড়ে গেল তখন মানুষ একেবারে আটঘাট বেঁধে লাগলো যে, এইবার কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে কিছু করেই ছাড়ব। একুশ শতকের একেবারে শুরুর দিকে তা করেও ফেলল। মেশিন লার্নিং টেকনিক সফলতার সাথে প্রয়োগ করা শুরু করে দিল। তখন থেকেই আর আমাদেরকে এই ফিল্ড দিয়ে কিছু হবে কিনা এমন দুশ্চিন্তাই পড়তে হয়নি।

পরবর্তীতে একে একে সব চিন্তা-ভাবনা যা অনেক আগের মানুষগুলো করে গেছিল সব গুলোকে বাস্তবে রূপ দিতে থাকে। লক্ষ-কোটি তথ্য নিয়ে কম্পিউটারকে শিখানোর জন্য আবিষ্কৃত হয় ডীপ লার্নিং।আর তা মানুষের ব্রেইনের মতো করে প্রসেস করার জন্য নিউরাল নেটওয়ার্ক আরও কত কি!

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কীভাবে কাজ করে?

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি সাধারণত অ্যালগরিদম ও মেশিন লার্নিং-সুবিধা কাজে লাগিয়ে বিশাল তথ্যভান্ডার বিশ্লেষণ করে ফলাফল ও অনুমান জানিয়ে থাকে।

আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স এর সুবিধা

আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্ট কখনো ভুল করে না। মানুষ কোন না কোন সময় ভুল করতে পারে। তবে এ আই এর প্রোগ্রাম যদি সঠিকভাবে করা হয়। তাহলে এয়ার কখনই ভুল করে না।যেহেতু এআইয়ের সিদ্ধান্তগুলো ডিজাইন করা এলোগরেদম থেকে আসে তাই তার কাজে কখনোই ভুল হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। সব সময় সঠিক তথ্য এবং সঠিক পারফরমেন্সের কারণে সময় এবং অর্থ সঞ্চয় হয় যার ফলে এ আই আপনার কোম্পানিতে একটি উইন উইন সিচুয়েশন তৈরি করে।

দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুবিধা দেয়। মানুষ যে কোন সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় সিদ্ধান্ত হীনতায় ভোগে। অনেক কিছু চিন্তা-ভাবনা করার পরেও মানুষ কনফিডেন্স পায়না। এই সিস্টেম বিভিন্ন মেশিন লার্নারের মাধ্যমে মানুষের থেকে অনেক দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে। এর ফলে কাজ অনেক দ্রুত সম্পাদন হয় এবং অনেক সময় সঞ্চয় হয়।

একটানা সাত দিন ২৪ ঘণ্টা কাজ করার ক্ষমতা রাখে এই আয়। মানুষ কখনোই সাত দিন ২৪ ঘন্টা একটানা কোন কাজ করতে পারে না। মানুষের ঘুম এবং বিশ্রামের প্রয়োজন৷ এ আই একটি মেশিন তাই তার কোন বিশ্রামের প্রয়োজন হয় না।
এছাড়াও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এত এত সুবিধা রয়েছে যা বলে শেষ করা যাবেনা। কিন্তু প্রত্যেকটি ভালো জিনিসের কিছু মন্দ দিক থাকে। এখন আমরা জেনে নিব কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কিছু অসুবিধা সম্পর্কে।

আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স এর অসুবিধা

এ আই (AI) সিস্টেমের অসুবিধার কথা বলতে প্রথমে যেটি নজরে আসে সেটি হচ্ছে এ আই সিস্টেম অত্যন্ত ব্যয়বহুল। এ আই সিস্টেমের সব সময় লেটেস্ট হার্ডওয়ার এবং সফটওয়্যার সহ নিয়মিত আপডেট রাখার জন্য এবং কর্মিদের প্রশিক্ষণ এর জন্য কম্পানিকে সব সময় মোটা অংকের টাকা গুন্তে হয়।

এটি কর্মসংস্থান কমিয়ে দেই। এ আই দিয়ে পুনরাবৃত্তিমূলক কাজ প্রতিস্থাপন করা গেলেও এটি কোম্পানির জন্য উপকারী তবে কর্মসংস্থান কে প্রভাবিত করে। শুধু তথ্য এবং প্রযুক্তির ক্ষেত্রে দক্ষতার অভাবে তাদের গতানগতিক চাকরিগুলো হারাবে। এবং তারা বেকারত্বের দিকে ধাবিত হবে।

সৃজনশীলতার অভাব। এআই সিস্টেম ব্যবহার করার অন্যতম একটি ঘাটতি হচ্ছে সৃজনশীলতার অভাব। কখনোই কোন সৃজনশীল চিন্তাভাবনা করতে পারে না। বিশেষ করে।

আবেগ অনুভূতি অনুপস্থিতি। যদিও এআই সিস্টেম দ্রুত এবং ক্রমাগত উন্নত কাজ করছে কিন্তু কোন সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় আবেগকে কাজে লাগাতে পারে না। এটি সত্যিকারের মানুষের সাথে আণবিক সংযোগ তৈরি করতে পারে না।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ভবিষ্যৎ

জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্রমাগত উন্নতির সাথে সাথে মানুষ গৎবাঁধা কায়িক শ্রমের কাজগুলো থেকে বেরিয়ে আসছে এবং এইসব কাজগুলো বিভিন্ন প্রযুক্তি যন্ত্রের মাধ্যমে করিয়ে নেওয়ার চেষ্টা অব্যাহত আছে। সামনের দিনগুলোয় যন্ত্রের এই প্রযুক্তিগত উন্নয়ন আরও বেগবান হবে।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এই অব্যাহত উন্নয়ন এক সময় মানুষের সক্ষমতাকে ও ছাপিয়ে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এই জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ChatGPT-সহ এই ধরনের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন প্রযুক্তির ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে। আবার অনেক দেশ নির্দিষ্ট নীতিমালার আলোকে এইসব প্রযুক্তি পণ্যকে ব্যবহারের জন্য অনুমতি প্রদান করেছে।

এইক্ষেত্রে একটি বিষয় মনে রাখতে হবে যে, অনেক বেশি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টাও বিপরীত ফল বয়ে আনতে পারে। কেননা আমরা দেখেছি, ক্রিপ্টোকারেন্সি -কে প্রচলিত লেনদেন ব্যবস্থায় যুক্ত না করার কারণে তা কিন্তু বন্ধ হয়ে যায়নি বরং তা ইন্টারনেট ভিত্তিক অপরাধ কর্মকাণ্ডে একটি আর্থিক মুদ্রা হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আমাদের জন্য ক্ষতিকারক না উপকারী তা হয়তো ভবিষ্যৎ ঠিক করে দেবে। তা যে আমাদের ওপরও অনেকখানি নির্ভর করবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না কারণ খনি খননের জন্য উদ্ভাবিত ডিনামাইটও কিন্তু যুদ্ধের ময়দানে ব্যবহৃত হয়েছে মানুষকে মারার জন্য, যুদ্ধ জয়ের জন্য।

সুতরাং অনেক ভালো প্রযুক্তিও খারাপ হয়ে যেতে পারে যদি তা খারাপ উদ্দেশ্যে খারাপ লোকের দ্বারা পরিচালিত হয়। আর সেই রকম কোনো কিছু যদি ঘটে, তাহলে আমাদেরও হলিউড, বলিউডের সিনেমার মতো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার রোবটের সাথে যুদ্ধ করে টিকে থাকার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।

সেই রকম কিছু যদি নাও ঘটে নিজেদের আগামীর প্রযুক্তি নির্ভর বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হলেও প্রযুক্তিগত দক্ষতা অর্জনে মনোযোগী হতে হবে। কেননা প্রকৃত অর্থেই আগামীর বিশ্ব হবে শুধুমাত্র যোগ্যদের বেঁচে থাকার জায়গা।

By Amit Kumar Basak

উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনী অমিত এখন বেসরকারী চাকুরীরত । পড়াশোনার পাশাপাশি লেখাটাও তার একটা নেশার মধ্যে পরে ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *