অমর্ত্য সেন (Amartya Sen) : অমর্ত্য সেন যিনি বাঙালির গর্ব তো বটেই , পাশাপাশি প্রতিটি মানুষের কাছে অনুপ্রেরণা। অমর্ত্য সেন দেশের প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ, লেখক এবং দার্শনিক। তিনি সমাজের অনগ্রসর ও দরিদ্র অংশের জন্য ন্যায়বিচার, সম্মান ও সাম্যের পথ উন্মুক্ত করতে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন। তিনি দেশের অনাহার এড়ানোর জন্য বেশ কয়েকটি উপায় উল্লেখ করেছিলেন, যা জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচী সূচক গঠনে সহায়তা করেছিল । তাঁর গবেষণার বিষয়গুলি ছিল সামাজিক তত্ত্ব, অর্থনৈতিক তত্ত্ব, নীতি ও রাজনৈতিক দর্শন, কল্যাণ অর্থনীতি তত্ত্ব, উন্নয়নমূলক অর্থনীতি ইত্যাদি।
১৯৯৮ সালে অর্থনৈতিক বিজ্ঞানে নোবেল মেমোরিয়াল পুরস্কার এবং ভারতের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান – ভারতরত্ন , ও পরের বছর কল্যাণমূলক অর্থনীতিতে তাঁর অবদানের জন্য তিনি ভূষিত হন। অমর্ত্য সেনের লেখা বইগুলো বিগত ৪০ বছর ধরে প্রায় ৩০ টি ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছে। আমাদের মধ্যে অনেকে হয়তো এটা জানা নেই যে ,২০০৬ সালে টাইমস ম্যাগাজিন তাকে অনূর্ধ্ব ৬০ বছর বয়সী ভারতীয় বীর হিসেবে চিহ্নিত করেছে এবং ২০১০ সালে তাকে বিশ্বের 100 প্রভাবশালী ব্যক্তির তালিকায় স্থান দেওয়া হয় ।
বিষয় সূচী
Toggleঅমর্ত্য সেনের জন্ম ও পরিচিতি
অমর্ত্য সেন ৩ রা নভেম্বর ১৯৩৩ সালে শান্তিনিকেতনে জন্মগ্রহণ করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার নাম রেখেছিলেন অমর্ত্য, যার অর্থ অমর বা অবিনশ্বর। অমর্ত্য সেন একটি সম্ভ্রান্ত বৈদ্যব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। অমর্ত্য সেনের বাবা অধ্যাপক আশুতোষ সেন এবং মা অমিতা সেন দুজনই ঢাকার মানিকগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। আশুতোষ সেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক এবং পরবর্তীকালে ওয়েস্ট বেঙ্গল পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে দিল্লিতে কর্মরত ছিলেন। পিতামহ সারদাপ্রসাদ সেন ছিলেন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট।
অমর্ত্য সেনের শিক্ষাজীবন
১৯৪১ সালে অমর্ত্য সেন ঢাকার সেইন্ট গ্রেগরী উচ্চ বিদ্যালয় পড়াশুনো করেন। তার পরিবার ভারত বিভাগে পরে ভারতে চলে আসেন। এখান এসে বিশ্বভারতী বিদ্যালয়ে ভর্তি হন তিনি । শৈশব থেকেই অমর্ত্য সেনের সংস্কৃত, গণিত এবং পদার্থবিজ্ঞানের মতো বিষয়ে আগ্রহ ছিল। ১৯৫৩ সালে তিনি কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বি.এ অর্থনীতিতে প্রথম শ্রেণীর সম্মান সহ স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। এবং ওই বছর তিনি কেমব্রিজের ট্রিনিটি কলেজে যান এবং ১৯৫৬ সালে বি.এ ডিগ্রী অর্জন করে।
অমর্ত্য সেনের কর্মজীবন
১৯৫৬ সালে, মাত্র ২৩ বছর বয়সে তিনি কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় অর্থনীতি বিভাগে অধ্যাপক এবং প্রধান হিসাবে নিযুক্ত হন। দুই বছর পর, তিনি পিএইচডি করার জন্য ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে জান । ১৯৫৯ সালে তিনি পিএইচডি থেসিস শিরোনাম “দ্যা চয়েজ অফ টেকনিকস” জমা দেন। ১৯৬১ সাল থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত তিনি দিল্লী স্কুল অফ ইকোনমিক্সের অধ্যাপক ছিলেন। এরপর ১৯৭৭ সাল থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে, ১৯৮৮ থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক হিসাবে অর্থনীতি ও দর্শন পড়িয়েছেন। ১৯৭০ সালে তার প্রথম গ্রন্থ ‘Collective Choice and Social Welfare’ (সামগ্রিক আগ্রহ এবং সামাজিক উন্নয়ন), যা মৌলিক কল্যাণ, সাম্যতা এবং স্বতন্ত্র অধিকার, ন্যায়বিচার বিষয়গুলিকে সম্বোধন করে। যা তার অন্যতম প্রভাবশালী মনোগ্রাফ হিসাবে বিবেচিত হয়। যার কারণে গবেষকদের মনোযোগ বুনিয়াদি কল্যাণের দিকে যায় এবং তারা এর থেকে অনুপ্রেরণা পান।
এরপর ১৯৭৩ সালে তার আরো একটি বই ‘On Economic Inequality’ (অর্থনীতিতে অসমতা)প্রকাশিত হয় । বইটি অর্থনৈতিক বৈষম্যের অধ্যয়নের সাথে সম্পর্কিত কল্যাণ অর্থনীতি তত্ত্বের একটি গবেষণা। ১৯৮২ সালে প্রকাশিত নিবন্ধ ‘দারিদ্র্য ও দুর্ভিক্ষ’। এই নিবন্ধটিতে খাদ্য সরবরাহের অপ্রতুলতার কারণ, অপুষ্টি এবং দুর্ভিক্ষ বিশ্লেষণের কারণ সমাজের সামনে তুলে ধরেছিলেন ।
১৯৮৭ সালে তার প্রকাশিত “নীতিশাস্ত্র ও অর্থনীতিতে” (‘On Ethics and Economics’)। এটি একটি সমালোচনামূলক রচনা ছিল। কল্যাণ অর্থনীতি এবং আধুনিক নীতিশাস্ত্রের পড়াশোনা একে অপরকে উপকৃত করতে পারে এই যুক্তি তুলে ধরা হয়েছিল এই বইটিতে ।১৯৯০ সালে নিউইয়র্ক রিভিউ অফ বইয়ের জন্য তিনি একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন যার শিরোনাম “১০ কোটির অধিক নারীকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না” (More Than 100 Million Women Are Missing)।১৯৯২ সালে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় প্রেস দ্বারা প্রকাশিত তার অসমতার পুনঃপরীক্ষণ বইটি অসমতার ধারণার পরীক্ষা করে এবং মূলত সামর্থ্য পদ্ধতির উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে।
১৯৯৯ সালে তিনি “আন্তর্জাতিক উন্নয়ন এবং “উন্নয়নমূলক অর্থনীতি” ধারণার উপর আলোকপাত করেছিলেন। উন্নয়ন ও স্ব-ক্ষমতা (Development as Freedom) শিরোনাম একটি বই প্রকাশ করে। ২০০২ সালে তার বইয়ের শিরোনাম ছিল যৌক্তিকতা ও স্বাধীনতা (Rationality and Freedom) যা দুটি ভাগে বিভক্ত করেছিল যৌক্তিকতা, স্বাধীনতা এবং ন্যায়বিচার।২০০৫ সালে তার জনপ্রিয় বই “তর্কপ্রিয় ভারতীয়” (The Argumentative Indian) প্রকাশিত হয়েছিল। বইটিতে ভারতের ইতিহাস, পরিচয়, সমসাময়িক ভারত এবং যুক্তিতর্ক ঐতিহ্য ফুটিয়ে তোলা হয়েছিল ।
২০০৯ সালে অ্যালেন লেন এবং হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় প্রেস দ্বারা ‘ন্যায়বিচারের ধারণা’ (The Idea of Justice) বইটি প্রকাশিত হয়।বইটি অর্থনৈতিক যুক্তির উপর একটি হাইলাইট করা হয়েছিল।তিনি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় অর্থনীতি ও দর্শন বিভাগের অধ্যাপক এবং টমাস ডব্লিউ ল্যামন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হিসাবেও কাজ করছেন।অমর্ত্য সেন সমাজে দারিদ্র্যসীমার নিচে বাসকারী সংখ্যাকে দারিদ্র্যের মান হিসাবে বিবেচনা করেছিলেন এবং যে কোনও সম্প্রদায়ের দারিদ্র্যের মাত্রা মাপার জন্য একটি জটিল সূচকও তৈরি করেছিলেন।তাঁর প্রকাশনা ‘স্বাধীনতার মতো উন্নয়ন’ (Development as Freedom) অর্থনৈতিক উন্নয়ন তত্ত্বের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল ,যার জন্য তিনি নোবেল পুরস্কার লাভ করেছিলেন।
১৯৯২ সালে তার ‘অসাম্যতা পুনরায় পরীক্ষিত’ (Inequality Reexamined) একটি প্রশংসিত বই। যা এক দশকের তার কাজের সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ থিমকে একত্রিত করেছে। এই বইয়ে তিনি অসমতার কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্বেগকে সম্বোধন করেছেন।
অমর্ত্য সেনের ব্যক্তিগত জীবন
নিজের ব্যক্তিগত জীবন অমর্ত্য সেনের খুব একটা ভালো ছিল না ।তার প্রথম স্ত্রী ছিলেন নবানীতা দেব সেন। যার দুটি সন্তান, অন্তরা সেন এবং নন্দনা সেন। তবে তাদের বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে যায় ১৯৭১ সালে। ১৯৭৩ সালে তিনি আবার বিয়ে করেন এভা কলোর্নি। এবং তাদেরও দুটি সন্তান ছিল। ১৯৮৫ সালে তিনি ক্যান্সারে মারা যান। দ্বিতীয় স্ত্রী মারা গেলে ১৯৯১ সালে তিনি এমা জর্জিনা বিয়ে করেন।
পুরস্কার ও সম্মান
১৯৫৪ সালে, তিনি অ্যাডাম স্মিথ পুরষ্কার পেয়েছিলেন।১৯৮৮ সালে তিনি ‘কল্যাণমূলক অর্থনীতির’ ক্ষেত্রে অবদানের জন্য অর্থনৈতিক বিজ্ঞানের নোবেল মেমোরিয়াল পুরস্কার পান।১৯৯৯ সালে তাঁকে ভারতরত্ন দেওয়া হয়েছিল, এটি ‘ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ পুরস্কার।২০১১ সালে তিনি ন্যাশনাল হিউম্যানিটিস মেডেল পান।
বলাই যায় অমর্ত্য সেন সারা জীবনে যে যে ভালো কাজ করেছে গরিব – অসহায় মানুষদের জন্য তাগুনে বলা কোনমতেই সম্ভব নয়