শবরীমালা মন্দির (Sabarimala Temple): শবরীমালা মন্দির ! যেখানে অনুমতি নেই মহিলাদের প্রবেশের। শবরীমালা মন্দিরের সৌন্দর্য পুরুষরা ভেতরে গিয়ে দেখতে পারলেও নারীদের ক্ষেত্রে নেই সেখানে অনুমতি । আর এর থেকেই শুরু এই মন্দির নিয়ে বিতর্ক।আমরা সবাই জানি এই শবরীমালা মন্দিরে পূজিত হন ভগবান আয়াপ্পা। হিন্দু ধর্মগ্রন্থ অনুযায়ী, এই আয়াপ্পা হলেন শিব ও মোহিনীর পুত্র। মোহিনী, যিনি আদতে ভগবান বিষ্ণু। সমুদ্র মন্থনের সময় অসুর থেকে অমৃত পান বঞ্চিত করার জন্য বিষ্ণু লিঙ্গ পরিবর্তন করে মোহিনী রূপ ধারণ করেন এবং তাঁর মোহিনী রূপের সৌন্দর্য দেখে আকৃষ্ট হন ভগবান শিব। সেখান থেকেই জন্ম হয় ভগবান আয়াপ্পা। পুরাণ মতে, এই আয়াপ্পা সারাজীবন ব্রক্ষ্মচারীর ধর্ম পালন করেছেন। ভগবান আয়াপ্পাকে উৎসর্গকৃত এই মন্দির কেরালায় অবস্থিত। মন্দিরটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১২৬০ মিটার (৪,১৩৪ ফুট) উচ্চতায়, আঠারোটি পাহাড়ের মাঝখানে একটি পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত এবং এটির চারিদিক ঘন বন দ্বারা ঘেরা ।
শবরীমালা মন্দিরে তীর্থযাত্রার সময়কাল পূর্বনির্ধারিত।এখানে বসবাসকারী মানুষদের মতে সবরিমালার তীর্থযাত্রা মালয়ালম বছরের বৃশ্চিক মাসের প্রথম দিনে শুরু হয় এবং ধনু মাসের ১১ তম দিনে শেষ হয়। ৪১ দিনের তীর্থযাত্রার এই মৌসুমটি মন্ডলা (ঋতু) নামে পরিচিত। ঋতুটি ডিসেম্বর এবং জানুয়ারি মাসে শুরু হয় ।
শবরীমালা মন্দিরের নিকটবর্তী রেলওয়ে স্টেশনটি হল, চেঙ্গানুর রেলওয়ে স্টেশন। এটি শবরীমালার প্রবেশদ্বার নামেও পরিচিত। কারণ অন্ধ্র, তেলেঙ্গানা, কর্ণাটক, তামিলনাড়ু এবং ভারতের বাকি অংশের ভক্তরা তাদের তীর্থযাত্রার জন্য চেঙ্গান্নুর রেলওয়ে স্টেশনে এসে এখান থেকেই শবরীমালা মন্দিরে যান।
শবরীমালা মন্দির থেকে আয়ের একটা বড় অংশ খরচ করা হয় ত্রিবাঙ্কুর এলাকার ছোট মন্দিরগুলিতে। TDB( ট্র্যাভাঙ্কোর দেবাসন বোর্ড) কর্মীদের বেতনও দেওয়া হয় এই অর্থ থেকেই। শবরীমালা মন্দিরের প্রসাদ আরবনা পায়সম’ তৈরিতে খরচ হয় প্রায় ৬০ শতাংশ। চাল, গুড়, ঘি এবং এলাচ দিয়ে তৈরি ক্ষীর ‘আরবনা পায়সম’ আয়াপ্পা স্বামীর বিশেষ প্রসাদ। শবরীমালা মন্দিরে নির্দিষ্ট অর্থের বিনিয়মে পুজোর বিশেষ বুকিং করা যায়। প্রসাদ কেনার ব্যবস্থাও রয়েছে।
মকর সংক্রান্তির দিন বিভিন্ন রাজ্যে বিভিন্ন নামে পুজো-পার্বণ চলে। এদিন কেরালার শবরীমালায় ভগবান আয়াপ্পা মন্দিরে মাকারাবিলাক্কু উৎসব হিসেবে পালন করা হয়। এই দিনে, ‘তিরুভভরনম’ নামে পবিত্র অলঙ্কার, যা দেবতার দ্বারা পরিধান করা হয়, পান্ডালম প্রাসাদ থেকে আনা হয় যেখানে ভগবান আয়াপ্পা তার শৈশব কাটিয়েছিলেন বলে বিশ্বাস করা হয়। সন্ধ্যা নাগাদ ভক্তরা মন্দিরে পৌঁছায়, এবং এর পরে একটি ‘দীপারাধনা’ হয়। ‘মকরবিলাক্কু’-এর উৎসবের দিন’, একটি প্রদীপ যা পাথানামথিট্টা জেলার পশ্চিম ঘাট পর্বতশ্রেণীর পোনাম্বালামেদু পাহাড়ে জ্বলে এবং সূর্যাস্তের পরে প্রদর্শিত ‘মকারা জ্যোতি’ তারকা কেরালায় মকর সংক্রান্তির দিনটিকে চিহ্নিত করে। দীপারাধনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় সাত দিনের মকরবিলাক্কু উৎসব।
শবরীমালা মন্দিরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যেটা নিয়ে কেরালা উত্তাল সেটা হল এখানে ১০ থেকে ৫০ বছর বয়সী মহিলাদের প্রবেশের বিরুদ্ধে ধর্মীয় বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে । কেরলের ঐতিহাসিক শবরীমালা মন্দিরের অন্দরে তাই প্রবেশ করতে পারেন না ঋতুমতী মহিলারা। তাঁদের প্রবেশ করতে দিলে আয়াপ্পাদেবের উপাসনাস্থল অপবিত্র হয়ে যাবে, এই যুক্তিতে প্রাচীনকাল থেকেই চালু এই রীতি। সেই পরম্পরা জারি করেছে মন্দিরের পরিচালক ট্র্যাভাঙ্কোর দেবাসন বোর্ড। সম্প্রতি তাকেই চ্যালেঞ্জ জানিয়ে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছিল একজন মহিলা আইনজীবী।
২৮শে সেপ্টেম্বর ২০১৮ -এ, ভারতের সুপ্রিম কোর্ট, ৪ – ১ সংখ্যাগরিষ্ঠ সিদ্ধান্তে (৪ পুরুষ এবং ১ মহিলা বিচার বিভাগীয় প্যানেল) , নারীদের প্রবেশের উপর নিষেধাজ্ঞা বাতিল করে। সুপ্রিম কোর্টের এই সিদ্ধান্তের পরে, কেরালার দক্ষিণাঞ্চলে প্রচুর বিক্ষোভ ও সমাবেশ হয়েছিল । ২৮শে সেপ্টেম্বর, ২০১৮ -এ নেওয়া সিদ্ধান্তের প্রতিক্রিয়ায়, ভক্তরা প্রায় ৬৫ টি রিভিউ পিটিশন দাখিল করেছিলেন । সেই সময় ভারতের সুপ্রিম কোর্ট তার নিজস্ব আদেশের বিরুদ্ধে রিভিউ পিটিশন গ্রহণ করে। মামলার গুরুত্বপূর্ণ তথ্য এবং পরিস্থিতির কারণে সুপ্রিম কোর্ট পিটিশনটি পর্যালোচনা করার এবং একটি জনশুনানি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল । মামলার শুনানিতে শীর্ষ আদালত মন্তব্য করে, ‘কর্তৃপক্ষ কখনই মন্দিরে মহিলাদের প্রবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে পারে না। সাংবিধানিক অধিকার না থাকলে এমন নির্দেশ জারি করা যায় না।’ সুপ্রিম কোর্টের বেঞ্চ জানতে চায়, ‘কী কারণে মন্দিরের ভিতর মহিলাদের প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না?’ এরপর সরকারকে আদালত প্রশ্ন করে, ‘গত ১৫০০ বছরে ওই মন্দির চত্বরে কি কখনও ঋতুমতী নারীকে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি?’ আদালতের প্রশ্নের উত্তরে কেরালা সরকার শবরীমালা মন্দির ইস্যুতে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করেছে। কেরালা সরকারের বক্তব্য, তারা সববয়সের সবমহিলার মন্দিরে প্রবেশাধিকারের পক্ষেই। এ নিয়ে কোনওরম বিধিনিষেধের বিপক্ষে। মহিলাদের সঙ্গে বৈষম্য হোক, এমন কিছুতে তাদের সায় নেই।
সুপ্রিম কোর্টের এই রায়ের ফলে নীলাক্কাল (Nilakkal) এবং পাম্বা বেস ক্যাম্পে ১৭ই অক্টোবর ২০১৮ -এ বিক্ষোভ দেখা দেয়, যখন আদালতের রায়ের পরে প্রথমবার মন্দিরটি খোলা হয়েছিল, তখন বিক্ষোভকারীরা নারী সাংবাদিকদের লাঞ্ছিত করে, তাদের ক্যামেরার সরঞ্জাম চুরি করে এবং একটি গাড়ির ক্ষতি করার পাশাপাশি পুলিশের ওপরও হামলা করা হয়। এমন কি সেই সময় আয়াপ্পান ভক্তরা বৃহৎ পরিসরে সমগ্র কেরালা এবং ভারতের অন্যান্য দক্ষিণ রাজ্য যেমন তামিলনাড়ু, আন্দ্র প্রদেশ এবং কর্ণাটকে , শবরীমালায় ১০ – ৫০ বছর বয়সী মহিলাদের প্রবেশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিল। এবং অনেক সরকারি জিনিস নষ্ট করার জন্য ১৪০০ অজ্ঞাত অংশগ্রহণকারীদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করাও হয়েছিল ।
২রা জানুয়ারী ২০১৯ -এ সকাল ৩:৪৫ নাগাদ , সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পর ,প্রথমবারের মতো ৪০ বছর বয়সী দুই মহিলাকে পুলিশ গার্ড দিয়ে সবরিমালা মন্দিরে নিয়ে যায়, অভিযোগ করা হয় যে পিছনের গেট দিয়ে কেরালার মুখ্যমন্ত্রী, পিনারাই বিজয়ন, তাদের প্রবেশ নিশ্চিত করেছিলেন । জানা গিয়েছিল ওই মহিলারা প্রবেশ করার পরে, পুরোহিতরা আচারিকভাবে শুদ্ধ করার জন্য মন্দিরটি এক ঘণ্টার জন্য বন্ধ করে দেয় ।
শীর্ষ আদালতের মতে , মন্দিরটি যেহেতু জনসাধারণের জন্য নির্মিত, সেখানে সকলের প্রবেশ অবাধ হওয়া উচিত। তবে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পরও মন্দিরে প্রবেশে বাধা দিচ্ছিল একাধিক সংগঠন। মন্দিরের প্রায় এক কিলোমিটার আগে থেকেই কার্যত এই সংগঠনগুলি দেওয়াল তুলে দিয়েছিল। কেউ মন্দিরে প্রবেশের জন্য পাহাড়ে উঠতে গেলেই তাঁদের বাধা দিচ্ছিল। এমনকি এখনো সেই পুরনো প্রথাই চলে আসছে