Northern LightsNorthern Lights

নর্দান লাইটস্ (Northern Lights) : মনে হতে পারে রহস্য! হতে পারে স্বপ্নের মতো। কিন্তু এও সত্যি। এই পৃথিবীর বুকেই এক আশ্চর্য সত্যকে সঙ্গে নিয়ে হাজার বছর ধরে বর্তমান অরোরা বোরিয়ালিস। বাংলায় একে বলা হয় মেরুজ্যোতি। এই মেরুজ্যোতি মূলত পৃথিবীর দুই চুম্বকীয় প্রান্তে দেখা যায় । উত্তর মেরুর আকাশে যে অরোরা দেখা যায় তাকে বলে অরোরা বোরিয়ালিস আর দক্ষিণ মেরুর আকাশে যে অরোরা দেখা যায় তাকে বলে অরোরা অষ্ট্রালিস।

প্রাচীন কালে মানুষ মেরুজ্যোতি নিয়ে নানা ধরনের গল্প ফেঁদেছে; তাদের সীমিত জ্ঞান দ্বারা যেভাবে সম্ভব সেভাবেই এর ব্যাখ্যা দাঁড় করানোর চেষ্টা করা হয়েছে। উত্তর-পূর্ব কানাডার অধিবাসীরা পৃথিবীকে সমতল মনে করতো আর আকাশকে ভাবতো ঢাকনা দেয়া তাঁবু যার মধ্যে আছে অসংখ্য ফুটো। মানুষ মারা গেলে তাদের আত্মা এই ফুটোর মধ্য দিয়ে স্বর্গে চলে যায় আর যাত্রার সময় অন্য আত্মাগুলো আলো ফেলে তাদেরকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যায়। এভাবেই তৈরি হয় মেরুজ্যোতি। অনেকে আবার মেরুজ্যোতিকে মৃত পশুর আত্মার নাচনের ফল বলে মনে করতো। উত্তর আমেরিকার উপজাতিরাও মেরুজ্যোতির সাথে মৃত আত্মার সম্পর্ক খোঁজার চেষ্টায় লিপ্ত ছিল।
দর্শনের স্বর্ণযুগে মেরুজ্যোতিকে এইসব উদ্ভট কল্পনার বাইরে এনে কিছুটা যৌক্তিক উপায়ে দেখার চেষ্টা করা হয়। সেক্ষেত্রে দার্শনিক অ্যানাক্সিমেনেস ও জেনোফেনস এর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বলা হয় ৫৯৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দের চতুর্থ মাসে গ্রিসের আকাশে মেরুজ্যোতি দেখা যায়। সে কথা অ্যানাক্সিমেনেস তাঁর একটি বইতে উল্লেখ করেন।

এরও প্রায় দুই হাজার বছর পর গ্যালিলিও তাঁর বানানো টেলিস্কোপ দিয়ে প্রথমবারের মতো সৌরকলঙ্ক পর্যবেক্ষণ করেন। সতের শতকে জ্যোতির্বিদ এডমন্ড হ্যালি মেরুজ্যোতির কারণস্বরূপ চৌম্বক ক্ষেত্রের কথা উল্লেখ করেন। প্রায় কাছাকাছি সময়ে বিজ্ঞানী আন্দ্রেস সেলসিয়াস হ্যালির কথার পুনরাবৃত্তি করেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে মেরুজ্যোতি নিয়ে উল্লেখযোগ্য একটি পরীক্ষা চালান নরওয়ের বিজ্ঞানী ক্রিশ্চিয়ান বার্কল্যান্ড। তিনি তাঁর নিজের বানানো একটি যন্ত্রের মাধ্যমে পরীক্ষা করে দেখান যে, চৌম্বকক্ষেত্রে একটি আলোকরশ্মি ফেললে তা চৌম্বক বলরেখা অনুসরণ করে দুটি চৌম্বক মেরুতে গিয়ে অবস্থান নেয় এবং সেই মেরুকে ঘিরে একটি আলোর বলয় তৈরি করে। তিনি বললেন, সৌরকলঙ্ক থেকে উৎপন্ন ইলেকট্রন ঠিক এভাবেই পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্রকে অনুসরণ করে মেরুতে গিয়ে মেরুজ্যোতি গঠন করে। মেরুজ্যোতির বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার পথে এটা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ধাপ।

Northern Lights

এবারে দেখা যাক আধুনিক বিজ্ঞান এবিষয়ে কী বলছে ।
আমাদের পৃথিবী অজস্র চৌম্বকক্ষেত্র দিয়ে ঘেরা যা আমাদের গ্ৰহকে বিভিন্ন মহাজাগতিক রশ্মি থেকে রক্ষা করে । সূর্য থেকে বেরিয়ে আসা কিছু ইলেকট্রন , প্রোটন প্রভৃতি দিয়ে তৈরি হয় সৌরবায়ু । এই সৌরবায়ু যখন তীব্র শক্তি নিয়ে পৃথিবীতে আসতে চায় তখন পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্র একে বাধা দেয় । ফলে সেই সৌরবায়ুর সব শক্তি ফুরিয়ে আসে এবং আয়নোইজেশন ঘটে অর্থাৎ এই সৌরবায়ু র মধ্যে উপস্থিত কণা বায়ুমণ্ডলের কণার সাথে বিক্রিয়া ঘটায়, যা রাতের বেলায় দেখা দেয় বর্ণিল আলোকচ্ছটা অর্থাৎ মেরুজ্যোতিরূপে ।

সৌরবায়ু মূলত নাইট্রোজেন এবং অক্সিজেনের সাথে বিক্রিয়া করে। এই বিক্রিয়ায় নাইট্রোজেন নীল আলো বা কখনো কখনো বেগুনী আলো উৎপন্ন করে । অবশ্য অরোরার রং উচ্চতার উপর ও নির্ভর করে । ভূপৃষ্ঠ থেকে 100 কিলোমিটার উচ্চতায় অক্সিজেন বিক্রিয়া করে সবুজ রঙ তৈরি করে । আবার উচ্চতা 250 কিলোমিটার হলে অক্সিজেন লাল রং তৈরি করে ।
যে সৌরবায়ু অরোরার মতো প্রাকৃতিক বিস্ময় আমাদের উপহার দেয় তা কিন্তু আমাদের বেশ কিছু ক্ষতিও করে । আয়োনাইজেশনের ফলে স্যাটেলাইট যোগাযোগে সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে । ফলে টিভি , রেডিও এবং নেভিগেশনে সমস্যা তৈরি হয় । সৌরবায়ুর মাত্রা বেশি হলে তা কোনো বড় এলাকা জুড়ে লোডসেটিং ঘটাতে পারে ।

আপনি যদি নিজের চোখে অরোরা দেখতে চান তাহলে আপনাকে উত্তর অথবা দক্ষিণ মেরুর কাছাকাছি যেতে হবে । অরোরা দেখার সবথেকে উল্লেখযোগ্য জায়গা গুলো হলো আইসল্যান্ড, কানাডা ও আলাষ্কা । এছাড়াও মেরু অঞ্চলের কাছাকাছি বেশ কিছু জায়গায় মাঝে মাঝে অরোরা দেখা যায় ।

By Amit Kumar Basak

উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনী অমিত এখন বেসরকারী চাকুরীরত । পড়াশোনার পাশাপাশি লেখাটাও তার একটা নেশার মধ্যে পরে ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *