Munnar

মুন্নার (Munnar) :কেরালার পশ্চিমঘাট পর্বতমালার শৈল শহর হিসেবে পরিচিত মুন্নার । যা একটি জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র । শহরটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৫২০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত। পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথ পেরিয়ে শুধু চা বাগানই নয় জলপ্রপাত, নদী, অরণ্য সব মিলে শহরটি অসাধারণ সুন্দর। শান্ত, নির্মল এই শহরটি মুথিরাপুরা, নল্লাথান্নি ও কুন্ডালা এই তিনটি পার্বত্য নদীর মিলনস্থলে গড়ে উঠেছে। এছাড়া চারদিকে শুধু সবুজ চা বাগান ও কখনো কখনো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে রাবারের গাছ। দক্ষিণ ভারতের ব্রিটিশ সরকারের কর্মকর্তারা তাদের গ্রীষ্মকালীন ছুটি কাটানোর জন্য মুন্নার শহরটিকে নতুন রূপে গড়ে তোলেন। তখন থেকে শহরটি জনপ্রিয় রিসোর্ট টাউন হিসেবে পরিচিতি পেতে থাকে।

মুন্নার শহরটি বেশ কয়েক বছর আগে মুথুভান উপজাতীয় সম্প্রদায়ের আবাসস্থল ছিল এবং উনিশ শতকে এটি স্থানীয় বৃক্ষ রোপনের একটি প্রধান অংশে পরিণত না হওয়া পর্যন্ত অনাবিষ্কৃত ছিল ।

মুন্নারে ঘোরার জায়গা (Places to Visit at Munnar)

মুন্নারে বেশ কয়েকটি সেরা দর্শনীয় স্থান আছে ।মুন্নার কেরালার একটি লুকানো রত্ন। মুন্নারের সৌন্দর্য অতুলনীয়, এবং এটি এখনও পর্যটকদের মধ্যে তুলনামূলকভাবে পরিচিত না হওয়ার কারণে, এটি আপনার জন্য একেবারে ব্যতিক্রমী প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ এর একটা আকর্ষণীয় জায়গা হতে পারে। সুতরাং, আপনি যদি আপনার ব্যস্ত সময়সূচী থেকে কিছু সময় বের করে এই চমত্কার হিল স্টেশনে যেতে পারেন তাহলে এই জায়গাগুলো ঘুরতে ভুলবেন না।

টাটা চা মিউজিয়াম (Tata Tea Museum)

মুন্নারে সারিবদ্ধ ওক গাছের রূপালি সাজ আর চা বাগান যে একবার দেখেছে সে-ই বুঝতে পারবে এর মহিমা। টাটা টি মিউজিয়াম এখানকার সবচেয়ে জনপ্রিয় টি ভ্যালি ট্যুর। পাহাড়ের পর পাহাড়ে কার্পেটের মতো বিছিয়ে রয়েছে চা বাগান। কীভাবে চা তোলা হয়, কীভাবে প্রসেস করা হয় ,সবকিছুর সাক্ষী হওয়ার জন্য পর্যটকেরা এই টাটা টি মিউজিয়াম দেখতে আসেন। এছাড়া টাটা গোষ্ঠী কীভাবে এখানে চায়ের বিপ্লব এনেছে তা ডকুমেন্টারি আকারে দেখানো হয়। ডকুমেন্টারি দেখানোর পর টি ফ্যাক্টরিটা ঘুরে দেখা এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা। মুন্নার কীভাবে ধীরে ধীরে চায়ের জনপ্রিয় সেন্টার হিসেবে গড়ে উঠেছে তা এখানে জানা যাবে।

Munnar Tea Estate

মুন্নার চা বাগান (Kolukkumalai Tea Estate)

যেদিকে আপনি তাকাবেন সেই দিক টাই উপরে নীল আকাশ এবং নীচে সবুজ ক্ষেত্র দেখতে পাবেন । মুন্নার চা বাগান এমনই দেখায়। এই বাগানগুলি তাদের উৎপাদিত চায়ের উৎকৃষ্ট মানের জন্য পরিচিত। কোলুক্কুমলাই টি এস্টেট এদের মধ্যে অন্যতম |

শীর্ষ স্টেশন (Top Station)

৬৭০০ ফুটের উপরে মুন্নারের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ; শীর্ষ স্টেশনটি পর্যটকদের জন্য একটি দুর্দান্ত সুন্দর স্থান । টপ স্টেশন থেকে মুন্নারের প্রকৃতির এক অন্য রূপ পর্যটকদের কাছে ধরা দেয়। চারদিকে শুধু সবুজের প্রদর্শনী। পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে সিঁড়ি। সেই সিঁড়ি ভেঙেই যেতে হয় ভিউ পয়েন্ট। ভিউ পয়েন্টের এক দিকে পশ্চিমাঘাট পর্বতমালা, অন্যদিকে তামিলনাড়ুর থেনি জেলার উপত্যকার নান্দনিক দৃশ্য দেখার মতো।

View Point Top Station

আতুক্কাদ জলপ্রপাত (Attukkad Waterfall)

আতুক্কাদ জলপ্রপাত যার মধ্যে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ধরা পড়েছে । পাহাড় এবং জঙ্গলের মধ্যে লুকিয়ে থাকা একটি সুন্দর জলপ্রপাতের বৈশিষ্ট্যযুক্ত, এই জনপ্রিয় পর্যটন স্পটটি আক্ষরিক অর্থেই সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে । আপনি যখন এই জলপ্রপাতটিতে পৌঁছাবেন, তখন জলপ্রপাতের গোড়ায় বা নিচে তৈরি হওয়া পুলে ডুব দিতে পারেন। এই জলপ্রপাতগুলির সৌন্দর্য তাদের কেরালার মুন্নার পর্যটন স্থানগুলি জনপ্রিয় করে তোলে ।

আনামুদি চূড়া (Anamudi Peak)

আনামুদি চূড়া হল মুন্নারের আরেকটি ট্র্যাকযোগ্য, সুন্দর চূড়া ।এটির অবিশ্বাস্য দৃশ্য এবং সবুজের জন্য অত্যন্ত জনপ্রিয়। উপরে থেকে, আপনি নীচের উপত্যকা এবং পশ্চিম ঘাটগুলির একটি দুর্দান্ত দৃশ্য দেখতে পাবেন এখানে । অনেকটা শীর্ষ স্টেশনের মতোই এই অঞ্চলে প্রতি 12 বছরে একবার নীলা কুরিঞ্জি ফুল ফোটে ও সেইসাথে এই পাহাড় এবং এর আশেপাশের অঞ্চলটি ভারতে এশিয়ান হাতির বৃহত্তম জনসংখ্যার হোস্ট হিসাবেও পরিচিত। সুতরাং, আপনি যদি ট্রেকিং পছন্দ করেন তবে এটি আপনার জন্য সেরা মুন্নার ভ্রমণ স্থানগুলির মধ্যে একটি ।

মাত্তুপেট্টি (Mattupetty Dam)

শহর থেকে ৮ কিলোমিটার দূরে মাত্তুপেট্টি ড্যামটি অবস্থিত। কুণ্ডলা, মুদ্রাপূজা ও নাল্লাথনি নদীর সংযোগ এই লেক। মাত্তুপেট্টি ড্যাম ও লেক পর্যটকদের কাছে এক আকর্ষণীয় পর্যটন স্থান। পাহাড় ঘেরা হ্রদের মনোরম দৃশ্য উপভোগ করার জন্য লেকের শান্ত জলে নিরিবিলি পরিবেশে শিখরা এবং প্যাডেল বোট এর ব্যবস্থা আছে, যা পর্যটকদের কাছে বিখ্যাত।

আনাইরাঙ্গাল ড্যাম

মুন্নারের আরও একটি জনপ্রিয় দর্শনীয় স্থান আনাইরাঙ্গাল ড্যাম। মুন্নার থেকে ২২ কিলোমিটার দূরে এই ড্যাম অবস্থিত। এখানে যাওয়ার রাস্তাটি বেশ আকর্ষণীয় । সড়ক পথে যেতে দুপাশে চোখে পড়বে খাড়া পাহাড় আর পাহাড়ের কোলে ছবির মতো সুন্দর কিছু গ্রাম।
কফি, চা, এলাচ বাগানে ঘেরা আনাইরাঙ্গাল একটি পিকনিক স্পটও। পাহাড়ের পাদদেশে ছোট ছোট গ্রাম্য রেস্তোরাঁয় বসে চা-কফির স্বাদ একবার চেখে না দেখলে জীবন অসম্পূর্ণই থেকে যাবে।

ইরাভিকুলাম ন্যাশনাল পার্ক (Eravikulam National Park)

মুন্নার থেকে ১৭ কিলোমিটার দূরে রাজামালাই অঞ্চলে অবস্থিত ইরাভিকুলাম ন্যাশনাল পার্ক। এখান থেকে দেখা যায় দক্ষিণ ভারতের সবচেয়ে উঁচু পাহাড় আনামুদি পিক। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২৬৯৫ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত এই পিক। অনেকেই এই পাহাড়ে ট্রেকিং করার জন্য আসেন। ইরাভিকুলাম বন এবং বন্যপ্রাণী দপ্তর থেকে অনুমতি নিয়ে এই শৃঙ্গে উঠা যায়। ইরাভিকুলাম ন্যাশনাল পার্কে ঘোরার জন্যে বাসের ব্যবস্থা আছে। এই পার্ক বিরল প্রজাতির প্রাণী নীলগিরি থরের জন্য বিখ্যাত। এছাড়াও হাতি, শম্বর, দুষ্প্রাপ্য প্রজাপতি এবং পাখী যেমন এখানে আছে তেমনি আছে নীলকুরিঞ্জি ফুল। ১২ বছরে মাত্র একবার ফোটে এই ফুল।
এছাড়া আছে ইরাভিকুলাম জলপ্রপাত। এ ঝর্ণা পাহাড় বেয়ে প্রবল উচ্ছ্বাসে নেমে আসছে। বৃষ্টি না পড়লে দেখতে পাবেন পশ্চিম ঘাটের পর্বতমালা। আর বৃষ্টি পড়লে তো কথাই নেই, সে এক অন্যরকম রূপ। আকাশের দিক থেকে চোখ সরাতে মন চাইবে না।

ইকো পয়েন্ট (Echo Point)

মুন্নার থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ইকো পয়েন্ট। এখানকার নিরিবিলি প্রাকৃতিক পরিবেশ যেকোনো পর্যটককে মুগ্ধ করে। লেকে বোটিং করার ব্যবস্থা ও বুনো ফুলের মন মাতানো গন্ধ চারপাশের পরিবেশকে মোহময় করে তোলে। ইকো পয়েন্টের কয়েকটি স্থানে বিভিন্ন রকম মশলা থেকে শুরু করে নানা ধরনের জিনিসপত্রের বেচাকেনার হাট বসে ।

পল্লিভাসল (Pallivasal)

মুন্নার শুধু পাহাড়ই নয় ছোট-বড় অসংখ্য জলপ্রপাতের জন্যও বিখ্যাত। এমনই এক জলপ্রপাত পল্লিভাসল। এখানেই কেরালার প্রথম জল-বিদ্যুৎ প্রকল্প অবস্থিত। মুন্নার থেকে ২৩ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত পল্লিভাসল পর্যটকদের পছন্দের এক স্থান।

ব্লুজম পার্ক (Blossom International Park)

মুন্নারের পথে পথে পর্যটকদের জন্য অপেক্ষা করে আছে নানা রকমের চমক। এমন এক চমকীয় স্থান ব্লুজম পার্ক। প্রায় ১৬ একর জায়গা জুড়ে পার্কটি আছে । মুন্নার থেকে ৩ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই উদ্যানে বিভিন্ন প্রজাতির ফুলের গাছ আর অর্কিডের সমারোহ চোখে পড়ার মতো।এমন কোনো রঙ নেই যার দেখা ব্লুজম পার্কে পাওয়া যাবে না। পার্কে পর্যটকদের জন্য নৌকা ভ্রমণ, সাইকেল চালানো, রোলার স্কেটিং ইত্যাদির নানা বিনোদনের ব্যবস্থা রয়েছে।

চিন্নার বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য (Chinnar Wildlife Sanctuary & Waterfalls )

কেরালার সংরক্ষিত অঞ্চলে নির্মিত বারোটি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যের মধ্যে চিন্নার বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য। এই অভয়ারণ্যটি, বিশেষ করে, বাঘ, চিতাবাঘ, বন্য হাতি, সরু লরিস কুমির, দাগযুক্ত হরিণ এবং বিভিন্ন প্রজাতির পাখির জনসংখ্যার জন্য পরিচিত।

মারায়ূর (Marayoor)

মুন্নারের একটি চমৎকার পর্যটন স্পট মারায়ূর। যেখানে আপনার দেখার জন্য অনেক কিছু রয়েছে। প্রথমত, সেখানে ডলমেন রয়েছে, যা প্রস্তর যুগে সেই সময়ের বসবাসকারী সভ্যতার দ্বারা নির্মিত হয়েছিল। দ্বিতীয়ত, এই অঞ্চলে প্রাকৃতিকভাবে ক্রমবর্ধমান চন্দন কাঠের বন রয়েছে। তৃতীয়ত, মারায়ুরে আখের ক্ষেত, বাঁশের বন এবং জলপ্রপাতও রয়েছে।

কলারিপাট্টু (Kalaripattu)

মুন্নার ভ্রমণে এসেছেন আর এখানকার ঐতিহ্যবাহী কলারিপাট্টু ও কথাকলি শো দেখবেন না তা কি হয়? কলারিপাট্টু কেরলের জনপ্রিয় মার্শাল আর্ট। কেরালার বাসিন্দারা মনে করেন, মার্শাল আর্টের জন্মস্থান এই কেরালাতেই। সারাদিন ধরে মুন্নারের বিভিন্ন জায়গার প্রাকৃতিক সুন্দর্য দেখার পর সন্ধ্যা বেলায় কিছুটা সময় হাতে নিয়ে দেখে নিতে পারেন কথাকলি ও মার্শাল আর্টের শো।

মুন্নার ভ্রমণের শ্রেষ্ঠ সময় (Best Time to Visit Munnar)

আপনি যদি মুন্নারে ঘুরতে যেতে চান তাহলে জুন থেকে সেপ্টেম্বর মাস হলে মুন্নার ঘোড়ার সেরা সময় ।কারণ এই সময় ওখানকার আবহাওয়া বেশ মনোরম থাকে।

কি ভাবে যাবেন (How to Reach Munnar)

শালিমার থেকে ত্রিবান্দ্রাম এক্সপ্রেসে এর্নাকুলাম জাংশন। চেন্নাই থেকেও এর্নাকুলামের ট্রন পাবেন। এর্নাকুলাম থেকে বাস বা গাড়িতে মুন্নার। কলকাতা থেকে ফ্লাইটে কোচি হয়ে যেতে পারেন। অথবা কলকাতা থেকে বেঙ্গালুরু তারপর কন্যকুমারী এক্সপ্রেসে।

এখানকার আবহাওয়া খুব সুন্দর । ভোরে তীব্র ঠাণ্ডা, আবার দুপুরে কখনো রোদ, কখনো মেঘ। বিকেলে আবার হঠাৎই বৃষ্টি। আবার বৃষ্টি থামতেই মেঘের আড়াল থেকে উঁকি দেয় চাঁদের মায়াবী আলো। স্থানীয়দের মতে, বর্ষাকালে মুন্নারের প্রকৃতি সবচেয়ে সুন্দর। তাই আর দেরি না করে কিছুদিনের ছুটি নিয়ে এখানে ঘুরতে যেতেই পারেন।

By Amit Kumar Basak

উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনী অমিত এখন বেসরকারী চাকুরীরত । পড়াশোনার পাশাপাশি লেখাটাও তার একটা নেশার মধ্যে পরে ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *