Sandeep MaheswariSandeep Maheswari

সন্দীপ মাহেশ্বরী (Sandeep Maheswari ) : যখন বাধা বিপত্তির সঙ্গে লড়াই করে টিকে থেকে সাফল্য , সুখ প্রাপ্ত মানবজীবনের প্রতিচ্ছবি আমাদের মনে ভেসে উঠে, তখন সবার প্রথম যে নামটি মনে পড়ে সেই নামটি হল সন্দীপ মহেশ্বরী । বর্তমানে শুধু ভারতে নয়, দেশ-বিদেশেও তার নাম ছড়িয়ে গেছে । যুবকদের এগিয়ে আনার জন্য, তাদের ভবিষ্যত সম্পর্কে হতাশা থেকে বের করে আনতে তার চেষ্টা অতুলনীয় । তার ‘ফ্রি মোটিভেশনাল লাইফ চেঞ্জিং সেমিনার’ খুবই বিখ্যাত। খুব অল্প বয়স থেকে জীবনে অনেক সংকটের মুখোমুখি হয়ে এই পর্যায়ে পৌঁছেছেন তিনি।

সন্দীপ মহেশ্বরী ২৮ সেপ্টেম্বর ১৯৮০ সালে দিল্লিতে জন্মগ্রহণ করেন। ছোটবেলা থেকেই অনেক কিছু করার কথা ভাবতেন সন্দীপ। শৈশব নিয়ে খোলাখুলি কথা বলেন না তিনি। তার বাবা ছিলেন একজন ব্যবসায়ী, রূপ কিশোর মহেশ্বরী । মা শকুন্তলা রানী মহেশ্বরী । সন্দীপের বাবার অ্যালুমিনিয়ামের ব্যবসা ছিল। প্রায় দশ বছর চলার পর এই ব্যবসা স্থবির হয়ে পড়ে। পরিবারকে সাহায্য করার জন্য, তিনি তার মায়ের সাথে একটি মাল্টি-লেভেল মার্কেটিং কোম্পানিতে যোগদান করেছিলেন।

বাবার ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সন্দীপের পুরো পরিবার আর্থিক সংকটে পড়তে শুরু করে। সঙ্কটের এই সময়ে সন্দীপের পরিবার যতটা না ভেঙে পড়েছে তার চেয়ে বেশি নিজেদের সংগঠিত করেছে। সেই থেকে সন্দীপ তার পরিবারের জন্য কিছু করতে চেয়েছিলেন। তিনি প্রথমে একটি ছোট ব্যবসার পর আরও অনেক কাজ শুরু করেন, যা বেশিদিন টেকেনি। শেষ পর্যন্ত সংসার চালাতে পিসিওর কাজ শুরু করেন। যেহেতু তখন মোবাইল তেমন ছিল না, কয়েকদিন এই কাজটা ভালোই চলে । তার মা ও তার সঙ্গে এই কাজ সামলাতেন।

পারিবারিক ও আর্থিক সংকটের কারণে মাঝপথেই পড়াশোনা ছেড়ে দিতে হয়েছিল সন্দীপকে। তিনি দিল্লির করোরিমাল কলেজ থেকে বাণিজ্যে স্নাতক ছিলেন, এবং 2000 সালে ফটোগ্রাফি শুরু করেছিলেন এবং প্রাথমিকভাবে এটিকে বিভিন্ন উপায়ে পেশা হিসাবে গ্রহণ করার চেষ্টা করেছিলেন। এই নিয়ে কয়েকজন বন্ধুর সাথে ছোটখাটো ব্যবসা শুরু করলেও সব ব্যর্থ হয়। কারণ ভাগ্য তার জন্য অন্য কিছু বেছে নিয়েছিল।

জীবনে পরিবর্তন

সন্দীপ মহেশ্বরী হতাশার সাথে জীবনযাপন করলেও একদিন তিনি বন্ধুদের সাথে একটি মাল্টি লেভেল মার্কেটিং কোম্পানির সেমিনার আলোচনায় অংশ নিয়েছিলেন। 18 বছর বয়সী সন্দীপের পরিপক্কতা ততটা ছিল না, সে সেমিনারে কিছুই বুঝতে পারেনি, সে যা শুনেছিল তার সবই তার অজানা ছিল। তারপর তিনি নিজেই আরো একবার তার হতাশার বিরুদ্ধে লড়াই করার সাহস জুগিয়ে নিজেই একটি নতুন ধরণের উদ্যোগ শুরু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যা আজ অনেক যুবককে জীবন সংগ্রামে অনুপ্রাণিত করে তুলেছে ।সন্দীপ অনুভব করতে শুরু করেছিল যে সংগ্রামের তিক্ত অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে না গেলে আপনি সফলতা পাবেন না। এরপর তিনি আরো অনেক চেষ্টা করতে থাকেন ।

ফটোগ্রাফি

প্রথমদিকে সন্দীপ মডেলিং শুরু করেন । মডেলিং চলাকালীন এক বন্ধু তার কাছে কিছু ছবি নিয়ে আসে। সেসব ছবি দেখে ফটোগ্রাফি করার সিদ্ধান্ত নেন । কিছু জ্ঞান অর্জনের পর, তিনি 2 সপ্তাহের ফটোগ্রাফি প্রশিক্ষণ কোর্সে ভর্তি হন। কোর্সে যোগদানের পর তিনি একটি দামি ক্যামেরাও কিনে ছবি তোলা শুরু করেন। ফটোগ্রাফির কোর্স শেষ করেও পথচলা তার জন্য কঠিন ছিল। তিনি দেখলেন, দেশের লাখ লাখ মানুষ ফটোগ্রাফার পেশার সঙ্গে যুক্ত আছে। । তিনি অনুভব করতে লাগলেন যে কি করা উচিত যা ফটোগ্রাফিকে অন্য স্তরে নিয়ে যাবে এবং এটিকে একটি নতুন ব্যবসার রূপ দেবে। তিনি সাহস সঞ্চয় করে একটি সংবাদপত্রে একটি বিনামূল্যের পোর্ট ফোলিওর বিজ্ঞাপন দেন এবং সেই বিজ্ঞাপনটি পড়ে অনেক লোক এসেছিলেন। সেই মানুষদের থেকেই জীবনের প্রথম আয় রোজগারের প্রক্রিয়া শুরু হয়। শুরু হলো ফটোগ্রাফির ব্যবসা। এবং ধীরে ধীরে এটিকে বিস্তৃত করে, তিনি ১২ ঘন্টা বিশ্ব রেকর্ডে ১০০ মডেলের ১০০০০ ছবি তুলে লিমকা বুকসে নিজের নাম নথিভুক্ত করেন। এই রেকর্ডের পর তার কাজের সংখ্যা বাড়তে থাকে। লিমকা বুকে নাম নথিভুক্ত করার পর তিনি প্রচুর ব্যবসা পেতে শুরু করেন। এই রেকর্ডের কারণে, অনেক মডেল এবং বিজ্ঞাপন সংস্থা তাঁর কাছে আসতে শুরু করে এবং খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তাঁর সংস্থা ভারতের বৃহত্তম ফটোগ্রাফি সংস্থায় পরিণত হয়। ২০০০৬ সালে, সন্দীপের মাথায় একটি নতুন আইডিয়া আসে এবং সেই আইডিয়া থেকে অনলাইন ইমেজ মার্কেট শেয়ারিং সাইটের উদ্ভব হয়। এটি দেশের সবচেয়ে বড় অনলাইন ফটোগ্রাফি কোম্পানি। এই মুহূর্তে তাদের ৪৫টি দেশ থেকে ৭০০০’এর বেশি ক্লায়েন্ট রয়েছে। এখন সন্দীপ লক্ষ লক্ষ যুবকদের অনুপ্রাণিত করে।

মোটিভেশনাল স্পিকার

তিনি বিভিন্ন সেমিনার এ একজন মোটিভেশনাল স্পিকার হিসাবে বক্তব্য রাখেন । কারণ তিনি জানেন কিভাবে জীবনে যুদ্ধ করে টিকে থাকতে হয়। এছাড়াও তিনি নানা ধরনের বই ও লিখে থাকেন। তিনি সবসময় মানুষকে ভবিষ্যত কে পজিটিভ ভাবে ভাবতে শিখায় এবং তিনি বাস্তবতা সম্পর্কে ধারণা দেয়ার চেষ্টা করেন এবং তিনি এটা সবাইকে বঝাইতে চান যে মানুষের ভেতরের ঘুরে দাড়ানোর মনোভাব টাই মানুষকে সফলতা এনে দেয়।

সকল সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান দের একজন চরম আদর্শ হচ্ছেন সন্দীপ মহেশ্বরী। যিনি জীবন এ সকল ধরনের ব্যর্থতা কে উপভোগ করে সেগুলো কে অতিক্রম করে জীবন কে সফলতা তীরে নিয়ে গেছেন। এবং তিনি সকলকে একটি শিক্ষা দিতে চান ,আর তা হল – জীবনে ব্যর্থতা থাকবেই এবং এই ব্যর্থতাই আমাদের আরো শক্তিশালী করে তুলতে সাহায্য করবে ।

পুরস্কার লাভ

তিনি ২০১৪ সালে “উদ্যোক্তা ইন্ডিয়া সামিট” দ্বারা ২০১৩ সালের সৃজনশীল উদ্যোক্তা পুরস্কারে ভূষিত হন। এছাড়াও তিনি “বিজনেস ওয়ার্ল্ড” ম্যাগাজিন দ্বারা শীর্ষ উদ্যোক্তা হিসাবে ও নির্বাচিত হন। গ্লোবাল মার্কেটিং ফোরাম কর্তৃক স্টার ইয়ুথ অ্যাচিভার হিসেবে তিনি নির্বাচিত হন ।

তিনি ব্রিটিশ হাইকমিশন থেকে ইয়াং এন্টারপ্রেনার অ্যাওয়ার্ড পান। ET Now চ্যানেল দ্বারা শীর্ষ উদ্যোক্তা পুরস্কার লাভ করেন তিনি ।

এর পাশাপাশি অনেক চ্যানেল তাকে বর্ষসেরা উদ্যোক্তা ঘোষণা করেছে।

সন্দীপ মাহেশ্বরীর সম্পত্তি

সন্দীপ মাহেশ্বরীর ইউটিউব চ্যানেলে মোট ২৮.৪ মিলিয়ন সাবস্ক্রাইবার রয়েছে। ক্যারিয়ারের শুরুতে মডেলিংয়ের চেষ্টা করেন সন্দীপ। পরে মডেলিং ছেড়ে ফটোগ্রাফি শুরু করেন। কিছুদিন ফ্রিল্যান্সার হিসেবে কাজ করেন। তারপর তিনি তাঁর নিজস্ব কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। একাধিকবার ব্যর্থতার মুখও দেখেছেন সন্দীপ। ২০০২ সালে একটি কোম্পানি চালু করেন, যেটি পরে বন্ধ হয়ে যায়। একটি কনসালটেন্সি ফার্ম খোলেন, সেটিও পরে বন্ধ হয়ে যায়। ২০০৬ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ইমেজ বাজার। এরপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। চিত্রগ্রাহকদের কাছে এক জনপ্রিয় প্রতিষ্ঠান। Imagesbazaar.com-এর প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও তিনি। তাঁর সাইটে প্রতিটি ছবি কমপক্ষে বিক্রি হয় ২০ হাজার টাকায়।

পাশাপাশি নিজের একটি ইউটিউব চ্যানেলও খোলেন, ও প্রেরণামূলক বক্তৃতা দিতে থাকেন। অনুমান, বর্তমানে সন্দীপ মাহেশ্বরীর মোট সম্পত্তির পরিমাণ ৪ মিলিয়ন ডলার (৩৩ কোটি টাকা)। তাঁর প্রায় ১৭ কোটি টাকার সম্পত্তি রয়েছে (জমি ও বাড়ি)। সন্দীপের দিল্লি পিতমপুরায় একটি অফিস রয়েছে। দিল্লিতে রয়েছে একটি বাড়িও। মাসে প্রায় ৩০ থেকে ৫০ লাখ আয় করেন সন্দীপ। তাঁর বার্ষিক আয় তিন থেকে চার কোটি টাকা। তিনি নিজে ইউটিউব থেকে একটা পয়সাও নেন না, এবং নিজে গুগল কে মেইল করেছিলেন যে তার ভিডিও তে যেন অ্যাড না চালানো হয়। লোককে মোটিভেট করার কাজ তা তিনি ফ্রি তাই করে থাকেন। 

By Amit Kumar Basak

উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনী অমিত এখন বেসরকারী চাকুরীরত । পড়াশোনার পাশাপাশি লেখাটাও তার একটা নেশার মধ্যে পরে ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *