Comparison of Padma Bridge with Bhupen Hazarika BridgeComparison of Padma Bridge with Bhupen Hazarika Bridge

দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় প্রকল্প পদ্মা সেতু। নির্মাণ জটিলতা থেকে শুরু করে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র এবং বৈদেশিক চাপ, সব জটিলতাকে দক্ষতার সাথে মোকাবিলা করে স্বপ্নের পদ্মা সেতু আজ স্বপ্ন নয় বাস্তব।কিন্তু এই সেতুর নির্মাণ ব্যয় নিয়ে দুর্নীতির নানা গুঞ্জন শোনা গেছে । কেউ কেউ আবার নির্মাণ ব্যয় নিয়ে এটিকে তুলনা করছে ভারতের ভূপেন হাজারিকা সেতুর সাথে। একটি পদ্মা সেতুর টাকা দিয়ে নাকি ৩০ টি ভূপেন হাজারিকা সেতু নির্মাণ সম্ভব! এটা কি সত্যি ?

অসমে ব্রহ্মপুত্রের উপনদী লোহিত নদীর ওপর নির্মিত ভূপেন হাজারিকা সেতুর সঙ্গে পদ্মা সেতুর বর্তমানে নির্মাণ ব্যয়ের তুলনা করা হলেও বস্তুত সেতু দুটি কোনভাবেই তুলনীয় নয়। একটি অপেক্ষাকৃত কম লোড বহনকারী ও কেবল সড়ক সেতু। অপরটি অর্থাৎ পদ্মা সেতু বহুগুণ লোড বহনযোগ্য সড়ক ও রেল সেতু। শুধু সেতুর দৈর্ঘ্য দিয়ে বা প্রতি কিলোমিটার ব্যয় দ্বারা দুটি সেতুর তুলনা করা যুক্তিসঙ্গত নয় ।

তবে পদ্মা সেতু নির্মিত হয়েছে বিশ্বের দ্বিতীয় খরস্রোতা নদী পদ্মার উপর। অন্যদিকে ভুপেন হাজারিকা সেতু নির্মাণে নদী শাসন করতে হয়নি। কিন্তু পদ্মা সেতু নির্মাণে শুধুমাত্র নদী শাসনেই ব্যয় হয়েছে ৮ হাজার ৯৭২ কোটি টাকা, যা নির্মাণ ব্যয় বৃদ্ধির একটি অন্যতম বড় কারণ বলে মনে করা হয় ।

বলা হচ্ছে, ভূপেন হাজারিকা সেতুর দৈর্ঘ্য ৯.১৫ কি.মি., যা সম্পূর্ণ ভুল তথ্য। প্রকৃত পক্ষে লোহিত নদীর ওপরে অর্থাৎ জলের ওপরে মূল সেতুর দৈর্ঘ্য মাত্র ৪ কিলোমিটার। ভূপেন হাজারিকা সেতুর দুইপ্রান্তে তীরসংলগ্ন নিচু জমির ওপর নির্মিত দুটি ভায়াডাক্ট বা উড়াল সড়ক রয়েছে। ২.৬ কি.মি. ঢোলা প্রান্তে এবং ২.৫৫ কি.মি. সাদিয়া প্রান্তে। অর্থাৎ মোট ৫.১৫ কি.মি. উড়াল সড়ক বা ভায়াডাক্টসহ ভূপেন হাজারিকা সেতুর মোট দৈর্ঘ্য ৯.১৫ কি.মি.।অন্য দিকে জলের ওপর নির্মিত পদ্মা সেতুর দৈর্ঘ্য ৬.১৫ কি.মি.। ভায়াডাক্ট ৩.৬৯ কি.মি.সহ পদ্মা সেতুর মোট দৈর্ঘ্য ৯.৮৪ কি.মি.। কাজেই মূল সেতুর দৈর্ঘ্যের তুলনায় পদ্মা সেতু ভূপেন হাজারিকা সেতুর চাইতে ২.১৫ কি.মি. দীর্ঘতর। আর ভায়াডাক্টসহ পদ্মা সেতু ভূপেন হাজারিকা সেতুর চেয়ে ০.৬৯ কি.মি. বেশি দীর্ঘ।

শিল্পী আব্দুল লতিফের গাওয়া ‘পদ্মারে তোর তুফান দেইখা/পরান কাঁপে ডরে; ফেইলা আমায় মারিস না তোর/সর্বনাশা ঝড়ে’ লাইনগুলোই যথেষ্ট পদ্মার ভয়ংকর রূপ বর্ণনার জন্য। সেই পদ্মার বুকে একটি সেতু তৈরির পরিকল্পনাই সাহসের বটে।

ডিজাইন ও নির্মাণ কৌশলের দিক থেকে ভূপেন হাজারিকা সেতু একটি সহজ, স্বল্প ব্যয় ও পরীক্ষিত প্রাচীন পদ্ধতির কংক্রিটবিম বীম ব্রিজ। পৃথিবীর স্বল্পদৈর্ঘ্যরে প্রাচীনতম অনেক সেতুই বীম ব্রিজ পদ্ধতির। বীম ব্রিজের সীমাবদ্ধতা হলো, ট্রাস ব্রিজের (পদ্মা সেতু) মতো কোন বিল্ট-ইন-সাপোর্ট থাকে না (শুধু পিয়ার/পিলারে সাপোর্ট থাকা)। এর ফলে সাধারণত ৮০ মিটারের চাইতে দীর্ঘ স্প্যান করা যায় না। ভূপেন হাজারিকা সেতুর স্প্যান দৈর্ঘ্য (দুই পিলারের দূরত্ব) ৫০ মিটার (১৬৪ ফুট)। অন্যদিকে পদ্মা সেতুর স্প্যান দৈর্ঘ্য ১৫০ মিটার (৪৯২ ফুট)।

 

ভূপেন হাজারিকা সেতুটি অপেক্ষাকৃত সহজ বীম ব্রিজ ডিজাইন কৌশলে নির্মিত। অনেকগুণ কম লোড বহনকারী এবং কেবল সড়ক সেতু হওয়ায় ভারতীয় প্রকৌশলীরা নিজেরাই এটি ডিজাইন ও বহুগুণ কম ব্যয়ে নির্মাণ করতে পেরেছেন। সম্পূর্ণ ভারতীয় উপকরণ ও যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে জটিল পদ্মা সেতুর তুলনায় এই ‘লো-টেক’ সেতু নির্মিত হয়েছে। অন্যদিকে পদ্মা সেতুর ডিজাইন, নির্মাণ, নির্মাণ-তদারকি করার জন্য বিদেশী কনসালট্যান্ট ও কনট্রাক্টরদের নিয়োগ করতে হয়েছে এবং অধিকাংশ নির্মাণ সামগ্রীও বিরল, দুষ্প্রাপ্য ও ব্যয়বহুল যন্ত্রপাতি আমদানি করতে হয়েছে।

 

২০১৮ সালে নাসার উপগ্রহ থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী ১৯৬৭ থেকে ২০১৮র মধ্যে পদ্মার ভাঙ্গনে ৬৬,০০০ হেক্টর (৬৬০ বর্গ কি.মি.) জমি বিলীন হয়েছে পদ্মাগর্ভে। ঘূর্ণি স্রোতের কারণে পদ্মার তলদেশে পলিমাটি সরে যাওয়ার (স্কাওয়ারিং) পরিমাণ মডেলিংয়ে সর্বোচ্চ ৬২ মিটার হতে পারে বলে প্রতীয়মান। অন্যদিকে ভূপেন হাজারিকা নদীর তলদেশে পাথরের স্তর থাকা ও নিচে কম্প্যাক্ট মিহি বালু থাকায় সেতু নির্মাণ সহজ হয়েছে বলে নির্মাণ প্রতিষ্ঠান নবযুগ ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের পরিচালক জানিয়েছেন। ভারতীয় সেতুটির পাশাপাশি পদ্মা সেতুর কিছু বৈশিষ্ট্য বিচার করলেই অভিযোগ উত্থাপনকারীদের যুক্তির অসারতা দিবালোকের মতো স্পষ্ট হবে।

প্রথমত- ভূপেন হাজারিকা সেতু ২ লেনবিশিষ্ট (একতলা) সড়ক সেতু। পদ্মা সেতু একটি সড়ক ও রেল সেতু। দুই তলাবিশিষ্ট পদ্মা সেতুর ওপরে চার লেন সড়ক সেতু এবং নিচে রেল চলাচলের ব্যবস্থা। তাছাড়াও অনেক বেশি লোড ও সৃষ্ট ভাইব্রেশনের কারণে রেল সেতুর নির্মাণ কৌশল অনেক জটিল এবং ব্যয় শুধু সড়ক সেতুর চেয়ে অনেক গুণ বেশি। দ্বিতীয়ত- ভূপেন হাজারিকা সেতুর প্রতি পাইলের লোড ক্ষমতা ৫২০ টন। আর পদ্মা সেতুর প্রতি পাইলের লোড ক্ষমতা ৮,২০০ টন। ভূপেন হাজারিকা সেতুর একটি পিলারের ভারবহন ক্ষমতা ১,৩২০ টন। আর পদ্মা সেতুর প্রতি পিলারের ভারবহন ক্ষমতা ৫০,০০০ টন।

ভূপেন হাজারিকা সেতু নির্মাণে ব্যবহৃত পাইলের দৈর্ঘ্য মাত্র ৪০ মিটার। পক্ষান্তরে পদ্মা সেতুতে ব্যবহৃত বিশ্বের গভীরতম পাইল ভূগর্ভে ১২২ থেকে ১২৫ মিটার পর্যন্ত প্রোথিত। উপরোক্ত তথ্য উপাত্ত থেকে এটি প্রতীয়মান যে, পদ্মা সেতু নির্মাণের ভূ-প্রকৃতিগত ও ভূতাত্ত্বিক চ্যালেঞ্জসমূহের মাত্রা ভূপেন হাজারিকা সেতুর থেকে অনেক গুণ বেশি। পদ্মা সেতু যদি হিমালয় হয়, তবে তার তুলনায় ভূপেন হাজারিকা সেতু একটি টিলা বা বড়জোর পার্বত্য চট্টগ্রামের একটি পাহাড়ের সমান।

 

সুতরাং দুটি সেতু কোন মতেই তুলনীয় নয় এবং সেতু দুটির সর্বমোট ব্যয় বা প্রতি কি.মি. ব্যয়ের তুলনা অজ্ঞতাপ্রসূত প্রচেষ্টা ছাড়া আর কিছু নয়।

By Amit Kumar Basak

উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনী অমিত এখন বেসরকারী চাকুরীরত । পড়াশোনার পাশাপাশি লেখাটাও তার একটা নেশার মধ্যে পরে ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *